(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
জেকসন হাইট এলাকায় ঘুরে আমার মনে হল এক টুকরো বাংলাদেশ। চারদিকে বাংলাদেশীদের দোকান, ব্যবসায়িক অফিস এবং দোকানের সাইনবোর্ডগুলিও বাংলায়। বিদেশে এরকম বাংলায় লেখা দেখে খুব ভাল লাগল। তারপর নিউইয়র্কের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গ্রাউন্ড জিরো অর্থাৎ ৯/১১ এর আগে টুইন টাওয়ার যেখানে ছিল ঐটা দেখতে। বর্তমানে টুইন টাওয়ারের জায়গায় ফোয়ারাসহ পার্কের মত করে বেশ নান্দনিক একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। ফোয়ারার চারিদিকে বেস্টনির উপর টুইন টাওয়ার দুর্ঘটনায় নিহত সবার নাম লেখা রয়েছে। গ্রাউন্ড জিরোর পর দেখতে গেলাম ঘধঃরড়হধষ গঁংবঁস ড়ভ ঃযব অসবৎরপধহ ওহফরধহ. ঐ যাদুঘরে আমেরিকার আদিবাসীদের এবং ঐতিহাসিক অনেক নিদর্শন দেখলাম। তারপর রকফেলার সেন্টার আর এম্পায়ার এস্টেট নামে ২টি বিখ্যাত বিল্ডিং দেখলাম। এম্পায়ার এস্টেট বিল্ডিংয়ের উপর থেকে পুরো নিউইয়র্কের ইরৎফং ঊুব ঠরব িদেখলাম। তারপর নিউইয়র্ক ষ্টক একচেঞ্জের সামনে বিশাল ষাড়ের মূর্তিটির সামনে ছবি তুলে গেলাম আমেরিকার স্বাধীনতার স্মৃতিস্মারক স্ট্যাচু অব লিভারটি দেখতে। স্বাধীনতার স্মৃতি স্তম্ভ ঝঃধঃঁব ড়ভ খরাবৎঃু দেখার জন্য হাড্সন নদী পথে ফেরী করে স্টেটেন আইল্যান্ড গেলাম। স্টেটেন আইল্যান্ড যাওয়ার পথে স্ট্যাচু অব লিভার্টি এবং নিউইয়র্কের ভিউটা দেখতে খুব ভাল লাগল। স্টেটেন আইল্যান্ডে কিছুক্ষণ ঘুরে ও কিছু সুভেনিয়ার কিনে নিউইয়র্কের ফেরীঘাটে ফিরে আসলাম। তখন জুলাই মাসের নিউইয়র্কের তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৩৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে তরমুজের জুস এবং আইসক্রীম খেলাম। তখন প্রায় বিকেল ৮ টা কিন্তু সূর্য অস্ত যায় নাই। আমেরিকাতে সামারে অনেক সময় ৯টার সময়ও সূর্যের আলো দেখা যায়। ফেরিঘাট থেকে ফিরার পথে দেখলাম মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেন, যেখানে ১৯৭১ সালে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ এই জায়গায় আসতে পেরে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হল এবং একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করেছিল। তারপর হোটেলে কাছে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে ডিনার শেষে হোটেলে ফিরে আসলাম। পরের দিন সকালে বের হয়ে পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু কোনাকাটার জন্য গধপু্থং ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলাম। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর নয় যেন বিশাল এক শপিং মল যেখানে প্রতিটি ফ্লোর আলাদা আলাদা পণ্যের জন্য। তৈরী পোশাক, জুতা, ব্যাগ, কসমেটিক্স সহ অনেক ধরনের পন্য। অনেক দোকানে মেড ইন বাংলাদেশ লিখা পন্য দেখে খুব ভাল লাগল। আজ তৈরী পোশাক শিল্পের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে এক পরিচিত নাম। বিশ্বের প্রায় অনেক নামি দামি ব্রান্ডের আউটলেট আছে। পরিবারের সবার জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে হোটেলে ফিরে আসলাম। রাত্রে কাছাকাছি একটা ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার শেষে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম কারণ পরের দিন সকালে বাসযোগে নিউইয়ার্ক থেকে ভার্জিনিয়ার বোনের বাসায় যাব। ঐখানে আমার সাথে দেখা করার জন্য আমার ছোট ভাই কানাডা প্রবাসী জাবেদ ইকবাল খান পরিবার নিয়ে কানাডা থেকে এসেছে। আমার বাসের টিকেট অনলাইনে আগে থেকে করা ছিল। নিউইয়র্ক থেকে বাস ছাড়ার পূর্ব মুহূর্তে এক ভারতীয় ভদ্রলোক ওনার বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমার পাশে বসিয়ে দিয়ে অনুরোধ করলেন আমি যেন উনাকে বাসের শেষ স্টেশনের আগের স্টেশনের নামিয়ে দিতে সাহায্য করি। মহিলা উনার নিউইয়ার্কে ছেলের বাসা থেকে ভার্জিনিয়ায় মেয়ের বাসায় প্রথমবার একা যাচ্ছিলেন। পূর্ব নির্ধারিত সকাল নয় টায় ঠিক সময় বাস ছাড়ল। বিলাস বহুল বাস। যেতে যেতে পথে ফিলাভেলফিয়া, ডেলওয়ার (বর্তমানে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শহর) ইত্যাদি অতিক্রম করলাম। হাইওয়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে বাস ছুটে চলছে এবং জানালা দিয়ে আমি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। পথিমধ্যে নির্ধারিত গন্তব্যে ভারতীয় ঐ মহিলাকে নামিয়ে দিয়ে বাস শেষ স্টপেজে পৌঁছে গেল প্রায় দুপুর ১টার দিকে। পথে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগল। বাস থেকে নেমে আমার বোন শারমিনকে ফোন করাতে ও বাসার কাজে ব্যস্ত থাকায় ভাই ইকবাল গাড়ী নিয়ে বাস স্টপেজে আসল এবং আমাকে নিয়ে ভার্জিনিয়ার বোনের বাসায় নিয়ে আসল। বোনের বাসায় আমরা তিন ভাই-বোন বাচ্চারা একসাথে মিলিত হলাম কিন্তু আমাদের আর এক ভাই পারভেজ দেশে থাকায় ওকে মিস করলাম এবং গল্প গুজবের মধ্যে বোনের বাসায় দুপুরের খাওয়া খেয়ে বিকেলে গেলাম ওর বাসার কাছে অবস্থিত কতগুলি বড় বড় কোম্পানীর ফ্যাক্টরী আউটলেট। ওখান থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে সবাই সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে খাওয়া দাওয়া শেষে আড্ডায় বসলাম। পরের দিন সকালে ছোট বোন আমাদেরকে নিয়ে একটা জাপানী রেস্টুরেন্টে ইৎঁহপয খাওয়ার জন্য নিয়ে গেল। ইৎঁহপয হল ইৎবধশভধংঃ এবং খঁহপয এর মাঝামাঝি সময়ের খাওয়া। আমরা অনেকদূর ড্রাইভ করে প্রায় ১২ টা দিকে ঐ রেস্টুরেন্টে পৌঁছালাম। বুফে খাবার, অনেক রকম জাপানীজ, চাইনিজ, আমেরিকান খাবারের আয়োজন। কিন্তু একটু ঊীঢ়বহংরাব। ভরপেট খেয়ে বোনের বাসায় ফিরে আসলাম কারণ বিকেলে আবার বোনের ননদের বাসায় দাওয়াতে যাওয়ার জন্য মেরিল্যান্ডের পথে রওনা দিতে হবে। আমরা সবাই আমার ভাই ও বোনের দুইটি গাড়ি নিয়ে মেরিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ওখানে পৌঁছাতে প্রায় ২ ঘন্টা লাগল। পথে মধ্যে মেরিল্যান্ডে অবস্থিত বিশ্ববিখ্যাত জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম। জন হপকিন্স ট্রপিক্যাল মেডিসিন এবং গবেষনার জন্য বিশ্ব বিখ্যাত। রাত্রে বোনের ননদ আলিয়ার হাতের অনেক পদের বাঙালি খাবার খেয়ে গেলাম মেরি ল্যান্ড থাকা আমার চাচাত বোন সামিনার বাসায় ওর বর ডাঃ ইমরান কার্ডিওলজিস্ট। ওর বাসায় চা-নাস্তা এবং আড্ডা অনেক রাত পর্যন্ত চলল। আড্ডা শেষে ভার্জিনিয়ায় বোনের বাসায় ফিরে আসলাম। পরের দিন বিকেলে সবাই মিলে পটোমেক (ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড মাঝখানে প্রবাহিত) নদীর তীরে গ্রেড ফলস নামে একটা সুন্দর পার্কে গেলাম বারবিকিউ করার জন্য। বিশাল নান্দনিক পার্ক অনেক দেশের অনেক লোক। সবাই যার যার মত মজা করছিল। পার্ক থেকে ফিরার পথে মুশল ধারে বৃষ্টি এবং বজ্রপাত শুরু হল। রাস্তায় পানিও জমে গেল।
প্রচণ্ড বজ্রপাতের কারণে আমাদেরকে গাড়ি একটা বড় দোকানের সামনে অপেক্ষা করাতে হল। আমেরিকায় নাকি আগে এতটা বজ্রপাত হত না বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সারা পৃথিবীর আবহওয়া বদলে যাচ্ছে। বৃষ্টি এবং বজ্রপাত কমে আসলে আমার বোনের বাসায় ফিরে আসলাম। পরের দিন সকালে উঠে লাগেজ গুছিয়ে নিলাম কারণ বিকালে দেশে ফেরার ফ্লাইট। তাই দুপুরের খাবার শেষে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ছোট ভাই ইকবাল ও শারমিন আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে গেল। আমি চেক ইন করে এমিরেটস্ এয়ারলাইন্সে ওয়াশিংটন থেকে দুবাই পৌছাতে লাগল প্রায় ১৫ ঘন্টা। দুবাই এয়াপোর্টে ট্রানজিট টাইম ছিল ৩ ঘন্টা। একটু শপিং এরিয়া ঘোরাঘুরি করে এবং চকলেট, বাদাম ইত্যাদি কিনতে প্রায় ২ ঘন্টা কেটে গেল। এয়ারপোর্টে যত না এরাবিয়ান লোক তার চেয়ে বেশী দেখলাম ভারতীয়। এর থেকে বোঝা যায় মধ্য প্রাচ্যে ভারতীয়দের আধিপত্য। তারপর বিমানে আরোহন করে প্রায় ৫ ঘন্টা পর ঢাকায় এসে পৌঁছলাম।
(চলবে)