আমেরিকার রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া

মেজর মোঃ এমদাদুল ইসলাম (অবঃ)

| বৃহস্পতিবার , ৬ নভেম্বর, ২০২৫ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী ৩৪ বছর বয়সী জোহরান মামদানি স্বতন্ত্র প্রার্থী নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর এ্যান্ড্রু কমো’র মত বিত্তবান এবং ক্ষমতাশালী প্রার্থীকে পরাজিত করে আমেরিকা তথা সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক চমক সৃষ্টি করেছেন। উল্লেখ্য, এই র্ন্বিাচনের চুড়ান্ত মুহূর্তে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি মামদানির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। একই অবস্থান ছিল বিশ্বের এক নাম্বার ধনী ইলেন মাস্কেরও। এত সবের পরও জোহরান মামদানি সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তার বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। র্ন্বিাচন প্রচার চলাকালীন মামদানিকে নিয়ে আমেরিকান গণমাধ্যম সি এন এন, ফক্স নিউজ, এন বি সি সহ ইলেট্রনিক্স মিডিয়াগুলি যেমন সরগরম ছিল তেমনি প্রিন্ট মিডিয়া’র নিউইর্য়ক টাইম’স, ওয়াশিংটন পোস্ট ইত্যাদিরও লেখালেখির অনেকটা ধুম পড়েছিল।

মামদানিকে নিয়ে এর মধ্যে আমেরিকান রাজনীতিতে চরম বিভক্তিও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম এরই মধ্যে মামদানিকে ‘সোস্যালিস্ট লুনাটিক’ তথা সমাজতান্ত্রিক এক উন্মাদ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিম এবং অভিবাসী হিসাবেও তাকে সমালোচনার মুখে দাঁড় করানো হয়েছে। ইসরাইলের পরে নিউইর্য়কেই সবচেয়ে বেশি ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের বাস। এই ইহুদি সম্প্রদায়ের বেশ কিছু সম্মুখ সারির নেতাও মামদানির বিরুদ্ধে বেশ কোমর বেঁধে বিরোধিতায় নেমেছিলেন। রিপাবলিকানদের অনেকেই মামদানির নাগরিকত্ব বাতিল করে তাকে উগান্ডা ফেরত পাঠানোর প্রস্তাবও করেছিলেন। ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেও মামদানির অনেক সমালোচক দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। তারমধ্যে নিউইর্য়ক’ এর সাবেক গভর্নর এ্যান্ড্রু কমো, সাবেক মেয়র রুডি জুলিয়ানী বর্তমান মেয়র এ্যারিখ এ্যাডামস অন্যতম। এইসব ডেমোক্র্যাটদের সমালোচনার বিষয় ছিল মামদানি অনভিজ্ঞ এবং পরীক্ষিত নন। রুডি জুলিয়ানি আগ বাড়িয়ে এও বলেছিলেন ‘মামদানি নিউইর্য়ককে ধ্বংস করে দেবেন’।

এত সবের পরও মামদানির ঘোষিত কর্মসূচি তাকে সাধারণ মানুষের কাছে দিন দিন ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। সিনেটর বার্নিকাট এর মত সিনেটর এবং লক্ষ লক্ষ তরুণ ভোটার মামদানির পক্ষ নিয়েছেন দৃঢ় প্রত্যয়ে। সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী প্রায় ৪০ হাজার তরুণ তরুণী মামদানির হয়ে প্রচার চালিয়েছেন অবিরাম।

প্রশ্ন উঠেছে মামদানির পক্ষে ওঠা বা তাকে বিজয়ী করার এই গণজোয়ারের কারণ কী এবং তার সাথে এত বৈরীতাও বা কেন হয়েছে? কারণ মামদানি ডেমোক্র্যাট তথা আমেরিকার গতানুগতিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এই অবস্থানের মূলে যে শব্দটি চুম্বকের মত সাধারণ মানুষকে আকর্ষণ করেছে সেটি হল ‘Afordable’। মামদানি তার প্রচার কার্যের প্রায় প্রতি মুহূর্তে নিউইর্য়ক শহরকে মানুষের বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ‘এ্যাফোর্ডেবল’ তথা বাসযোগ্য সাশ্রয়ী হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এসেছেন। এটি করার জন্য তিনি যে প্রস্তাবনাগুলি তার প্রচারে সামনে নিয়ে এসেছিলেন তা হল :

) যখন তখন ঘর ভাড়া বৃদ্ধি বন্ধ করবেন, ) নিউইর্য়কে বিনা ভাড়ার বাস চালু করবেন, ) নিম্ন আয়ের মানুষদের চিকিৎসা সহজলভ্য এবং তাদের বাচ্চাদের জন্য বিনাব্যয়ে ডে কেয়ার ব্যবস্থা চালু করার ঘোষণা, ) নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য বাসস্থান সুবিধা প্রদান করার ঘোষণা, ) উপরোক্ত কর্মসূচি বাস্তবে রূপ দিতে তিনি ধনী এবং উচ্চবিত্তের উপর প্রগ্রেসিভ ট্যাক্সেসন তথা উচ্চহারে করারোপের কথা ঘোষণা দিয়েছেন।

তার ঘোষিত কর্মসূচি সমূহের মূল উদ্দেশ্য নিউইর্য়ককে সব মানুষের জীবন যাত্রার জন্য সাশ্রয়ী তথা ‘এ্যাফোর্ডেবল’ হিসাবে গড়ে তোলা। অর্থনৈতিক উপরোক্ত কর্মসূচির বাইরে মামদানির রাজনৈতিক বেশ কিছু বক্তব্য আমেরিকাজুড়ে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ) ইসরাইল গাজায় যা করছে তা গণহত্যা। খ) ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নাথানিয়াহু নিউইর্য়কে আসলে তাকে যুদ্ধ অপরাধী হিসাবে গ্রেফতার করা হবে। গ) আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম একজন ফ্যাসিস্ট। ঙ) ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের হত্যাকারী এবং চ) ‘ইন্তেফাদার’ বিশ্বায়ন।

তার অর্থনৈতিক সামাজিক কর্মসূচির জন্য আমেরিকান এ্যাস্টাবলিস্টমেন্টের তল্পীবাহকরা এর মধ্যে তাকে সমাজতান্ত্রিক উন্মাদ হিসাবে আখ্যায়িত করতে যেমন দ্বিধা করেননি তেমনি তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি’র নীতি কৌশলের উপরও তিনি বিশাল এক প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির উপর করা মন্তব্যের কারণে ভারতীয় জনতা পার্টির লোকজন মামদানির সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছিলেন। লোকসভা সদস্য অভিনেত্রী কঙ্গনা রাউত মামদানিকে ভারত থেকে পাকিস্তানের প্রতি বেশি অনুরক্ত বা ভক্ত বলে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। এরই মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যমের অনেকেই নিউইর্য়কের ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র গায়ে বোরকা পড়িয়ে দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বুঝাতে চেয়েছেন মামদানি মেয়র হলে নিউইয়র্কে মুসলমানদের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে এবং সেখানে পর্দা প্রথা চালু হবে।

এতসবের পরও মামদানির এই বক্তব্য সমূহ নিউইয়র্কবাসীকে আলোড়িত করেছে নিশ্চিতভাবে, এটা তার বিপুল জনপ্রিয়তা থেকে অনুমেয়। মামদানি আমেরিকান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিতর থেকে যে ক্ষয়ের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে তার দিকে ইঙ্গিত করে জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন Dignity is not a matter of market, অর্থাৎ মানুষের সম্মানগৌরব এগুলি বাজারে নির্ধারিত তথা কেনাবেচার বিষয় নয়, মানুষের সম্মান গৌরব এগুলি মানুষ মানুষকে দিতে হবে।

এত আলোচনা সমালোচনার এই মামদানি কে? পাঠকদের জন্য জোহরান কাউমে মামদানির কিছুটা পরিচয় তুলে ধরা প্রাসঙ্গিক। মামদানির জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৯১ উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায়। মামদানির বাবা মাহমুদ মামদানি জন্মসূত্রে ভারতীয়, উগান্ডান অধ্যাপক একাডেমেসিয়ান। মাহমুদ মামদানির উপনিবেশবাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আফ্রিকার ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষণা কর্ম পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য। তিনি আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বাবা মাহমুদ মামদানি তার সন্তান জোহরান মামদানির নামের মাঝে ঘানা’র স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী Kwame Nkrumah ’র কাউমে নামটি বসিয়ে ছেলের নাম রাখেন জোহরান কাউমে মামদানি।

মা মীরা নায়ার বিখ্যাত ভারতীয় ছবি ‘সালাম বম্বে’, ‘মনসুন ওয়েডিং’ ‘ভ্যানিটি ফেয়ার’ ইত্যাদির নির্মতা। মীরা নায়ার তার ছবির জন্য অস্কারের জন্য মনোনীত হন এবং তিনি পদ্মশ্রী খেতাব প্রাপ্ত।

৭ বছর বয়সে মা বাবা’র হাত ধরে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার পূর্বে মামদানির কেপটাউনের সেন্ট জর্জ গ্রামার স্কুলে পড়ালেখায় হাতেখড়ি। নিউইয়র্কে গিয়ে ভর্তি হন নিউইয়র্ক সিটি পাবলিক স্কুলে, পরে ব্রুনেক্স বিজ্ঞান স্কুলের ছাত্র হিসাবে বউদুউইন কলেজ থেকে আফ্রিকান স্টাডিজের উপর স্নাতক হন। স্কূল ছাত্র হিসাবে মামদানি ‘স্টুডেন্ট ফর জাস্টিস ফর প্যালেস্টাইন’ নামক একটি সংগঠন করে তার মাধ্যমে প্যালেস্টাইনীদের উপর ইসরাইলীদের বর্বরতার প্রতিবাদে সোচ্চার হন। কলেজে মামদানি একটি ক্রিকেট টিম গঠন করেন। এ ক্রিকেট টিম তার মাঝে একধরনের চেতনার উন্মেষ ঘটায়, তা হল ‘সংগঠিত হলে অভিষ্ঠে পৌঁছানো সম্ভব’।

এ চেতনাবোধ থেকেই হয়ত মামদানি নিউইর্য়কের ভাড়া আদায়ে অপারগ, ভাড়া বৃদ্ধিতে অতিষ্ট, চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহে অসমর্থ অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে থাকেন। একসময় এ মানুষদের জন্য নিউইর্য়ককে সাশ্রয়ী বাসযোগ্য করার প্রত্যয়ে মেয়র নির্বাচনেও নেমে পড়েন। মানুষের বিপুল ভোটে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসাবে মনোন্নয়ন পেয়ে অবশেষে তিনি এখন চুড়ান্ত বিজয়ও অর্জন করেছেন।

আমেরিকার রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম পুরুধা পুরুষ সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স জোহরান মামদানির এ বিজয়কে আখ্যায়িত করেছেন এভাবে In modern history of USA it is one of the most important victories. অর্থাৎ আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ এক বিজয়।

মামদানির নিউইয়র্কের মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়া সমগ্র আমেরিকার রাজনীতিকে এক আমূল পরিবর্তনের পথে ধাবিত করতে পারে। আমেরিকার সাধারণ মানুষ এবং বিশ্ববাসী এখন তা প্রত্যক্ষ করার অপেক্ষায়।

Dignity is not a matter of market, অর্থাৎ মানুষের সম্মানগৌরব এগুলি বাজারে নির্ধারিত তথা কেনাবেচার বিষয় নয়, মানুষের সম্মান গৌরব এগুলি মানুষকেই মানুষকে দিতে হবে। এই প্রত্যয়ে জোহরান কাউমে মামদানি’র রাজনীতির পথ চলা উদ্ভাসিত হোক। মামদানি’র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই প্রত্যয় দীপ্ত উচ্চারণ ‘এখন সময় এসেছে মানুষই রাজনীতির মৌল বিষয় হওয়ার’। কামনা করি সমগ্র বিশ্বে এবং আমাদের দেশের রাজনীতিতেও মানুষই যেন রাজনীতির মৌল বিবেচ্য বিষয় হয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধইতিহাস সৃষ্টি করে নিউ ইয়র্কের প্রথম মুসলিম মেয়র মামদানি