চট্টগ্রামের নবাগত জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেছেন, আমি সবার ডিসি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমার কাছে সবাই সমান। সবাইকে নিয়েই আমি ভালো থাকতে চাই। চাই সবাইকে ভালো রাখতে। দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের কোথাও বিন্দুমাত্র দুর্নীতি হলে সরাসরি আমার কাছেই আসবেন। আমাকে বলবেন। ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি জেলা প্রশাসকের দুয়ার সবসময়ই সবার জন্য খোলা বলেও উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসনের কার্যক্রম শুরু ১৭৭২ সালে। ব্রিটিশ নাগরিক মি. ব্রেন্টলি ছিলেন প্রথম ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর। ব্রিটিশ শাসনামল এবং পাকিস্তান শাসনামল গেছে। বাংলাদেশও পার করছে ৫৩ বছর। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন পার করেছে আড়াইশ’ বছরেরও বেশি সময়। এই সুদীর্ঘ কালে চট্টগ্রামে কখনো কোন নারী জেলা প্রশাসক ছিলেন না। চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথম নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফরিদা খানম। গতকাল অষ্টম কর্মদিবস পার করেছেন তিনি। দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে প্রশ্ন ছিল– কেমন লাগছে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন। তিনি হেসে উত্তর দিলেন, নারী জেলা প্রশাসক হিসেবে প্রথম যোগ দিতে পেরে ভালো লাগছে। চট্টগ্রাম বড় জেলা, ব্যস্ত জেলা। এতো বড় একটি জেলার দায়িত্ব পালন করতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও আছে। সুবিধা যেমন আছে, তেমন কিছু অসুবিধাও আছে। তিনি বলেন, এটা শুধু চট্টগ্রাম বলেই নয়, সব জায়গারই কিছু বৈচিত্র্য আছে। নারী বলেও কোন সমস্যা নয়, সবাইকে এসব বৈচিত্র্য মোকাবেলা করেই কাজ করতে হয়। এসব কিছু নিয়েই চলতে হবে।
গতকাল বিকেলে নিজ কার্যালয়ে বসে দৈনিক আজাদীকে দেয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, চট্টগ্রামের আর কোন পাহাড়ে একটি কোপও কাউকে দিতে দেয়া হবে না। চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোকে রক্ষা করতে আমরা কঠোর থেকে কঠোরতর হবো। যে যতই শক্তিশালী হোক না কেন, একটি পাহাড়ও আর কাউকে কাটতে দেবো না। একই সাথে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী মানুষগুলোকেও আমরা পুনর্বাসন করার চেষ্টা করবো। পাহাড় ধসে যাতে আর কারো মৃত্যু না ঘটে তা নিশ্চিত করতে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন কাজ করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ওখানে প্রচুর দুর্নীতি হয়। আমি অনেকগুলো অভিযোগ পেয়েছি। প্রত্যেকটি অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখছি। যেখানেই দুর্নীতি হবে সেখানেই প্রশাসনের হাত পড়বে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, আমি এই ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন করে একটি জনবান্ধব, জনমুখী এবং কল্যাণময় প্রশাসন করতে চাই।
রক্তস্নাত একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশের যে যাত্রা শুরু হয়েছে সেখানে সরকারের সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে আমি চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করতে চাই। সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চাই। ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নতুন যে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মেধা, সততা ও দক্ষতার সাথে আমি তার প্রতিনিধিত্ব করতে চাই। ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমি চট্টগ্রামকে দেশের সেরা জেলায় পরিণত করতে চাই। চট্টগ্রামের মানুষদের ধন্যবাদ দিয়ে নবাগত জেলা প্রশাসক বলেন, চট্টগ্রামের ঐহিত্য হাজার বছরের। এখানের কৃষ্টি–সংস্কৃতির মতো চট্টগ্রামের মানুষের হৃদয়টাও অনেক বড়। এই চট্টগ্রামে ভালো কিছু করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
তিনি চট্টগ্রামকে আধুনিক এবং সবার বাসযোগ্য একটি জনপদ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাংবাদিকসহ সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
চট্টগ্রামের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে চান বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাইকারী বাজারের সাথে খুচরো বাজারের বড় গরমিল পরিলক্ষিত হয়। মধ্যস্বত্বভোগীরা সক্রিয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে আমরা কাজ করবো। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করবেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আসন্ন দুর্গাপূজা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিন স্তরের নিরাপত্তা চাদরে পুরো জেলাকে ঢেকে ফেলা হবে। প্রতিমা তৈরি থেকে বিজর্সন পর্যন্ত সর্বত্রই দেয়া হবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা। তিনি পুলিশ, আনসার সদস্যদের পাশাপাশি এক্ষেত্রে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যদেরও যুক্ত করা হবে। তিনি বলেন, এরা ফ্রেশ ব্লাড, এদের কাজে লাগিয়ে আমরা উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবো। তিনি বলেন, প্রতিটি পূজামন্ডবে সিসিটিভি ক্যামেরা থাকবে। যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার সুযোগ থাকবে না সেখানে যাতে কোন পূজা মন্ডব করা না হয় সেই নির্দেশনা দেয়া হবে। তিনি পূজা উৎসবকে ঘিরে যাতে কোন ধরণের অঘটন না ঘটে সে জন্য মাদক ও জুয়ার আসরের ব্যাপারে প্রশাসন কঠোর অবস্থান নেবে।
চট্টগ্রামকে পুরোপুরি একটি অসাম্প্রদায়িক জনপদ হিসেবে উল্লেখ করে জেলা প্রশাসক বলেন, এখানের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ইতিহাস বহু পুরানো। এখানে পূজাপার্বণকে ঘিরে কোন ধরণের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশংকা অন্তত আমি ব্যক্তিগতভাবে করি না। এখানের মানুষ ধর্ম বর্ণের উর্ধে উঠে মানুষকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন এবং সম্মান করে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী ফরিদা খানম ২০০২ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২৫ বিসিএসের (প্রশাসন) কর্মকর্তা হিসেবে ২০০৬ সালে সহকারী কমিশনার ও এঙিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে প্রথম যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর রংপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার, নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলা, সদর উপজেলা ও শরীয়তপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন ফরিদা খানম।
এরপর টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ফেনী জেলার দাগনভূঞাঁ উপজেলা ও নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়া মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রেষণে উপপরিচালক (ম্যাজিস্ট্রেট), বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনে উপপ্রধান, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরে উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফরিদা খানম। চট্টগ্রাম জেলায় জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পূর্বে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে উপ–সচিব হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এক পুত্র সন্তানের জননী ফরিদা খানম। তার স্বামী জহুরুল ইসলাম সফল একজন ব্যবসায়ী। বাবা কলেজ শিক্ষক মতিউর রহমান জাফরী। ঢাকায় জন্ম নেয়া ফরিদা খানমের স্বামীর বাড়ি হবিগঞ্জ। গত ৯ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ফরিদা খানমকে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।