বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময় জীবন কাটিয়েছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তাঁর সমগ্র কর্মকাণ্ডকে যদি দেখি, তাহলে দেখবো- নানান বর্ণিল ও সুরের ঐকতানে সমৃদ্ধ তাঁর জীবন। একদিকে তিনি যেমন ঝুঁকি ও সাহস নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন, আবার কোমলপ্রাণের অধিকারী বলেই তিনি নবপ্রজন্মের কাছে ছুটে গিয়েছেন নতুন আবাহনের জন্য। বৈচিত্র্যময় জীবন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের। সবাইকে লেখার জন্য উৎসাহ দিলেও তিনি নিজে লিখেছেন কম। একটি মাত্র বই লিখেছেন – ‘সৌদি আরবে পঁয়ত্রিশ দিন’। যদিও বা বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। আর কবিতা? তাও একটি মাত্র। অথচ তিনি ছিলেন একজন সুপাঠক।
একবার কথা প্রসঙ্গে আমায় বলেছিলেন- ‘লেখক হওয়ার আগে একজন ভালো পাঠক হওয়া অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই আমি বেশি বেশি পড়ি’। কথাটি আমার সারাজীবন মনে থাকবে। এবং আমি তা বিশ্বাস করি ও মেনে চলি। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ যে কবিতাটি লিখেছেন, তার নাম – ‘আমি শেষ নই’। কবিতার প্রথম স্তবক – ‘আমি শেষ নই আমার জীর্ণ পঞ্জরে তপ্ত এক প্রতীজ্ঞা জ্বল জ্বল করছে আর প্রতিনিয়ত আমাকে শক্তি দিচ্ছে এগিয়ে যাওয়ার’। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের বহুমাত্রিক জীবনের প্রথম ভাগের অধ্যায়ের সাথে কবিতার লাইনগুলো মিলে যায়। তিনি যখন রাউজান আর. আর. এ. সি স্কুলে পড়তেন, তখন থেকেই তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি এই ধরনের আয়োজনেও সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
জীবনের পরবর্তী পর্বে তাঁর এই দক্ষতাকে আমরা জাতীয়ভাবে পেয়েছি। ১৯৪০ সালে মেট্রিক পাস করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘রাউজান ইয়ংম্যান এসোসিয়েশন’। সুতরাং, সংগঠন গড়ে তোলা ও পরিচালনা করা তিনি তরুণ বয়স থেকেই করেছিলেন। ১৯৪০ সালে উপমহাদেশে শুরু হয় ‘ভারত বিভাগ চাই’ আন্দোলন। এর সাথে তিনিও যুক্ত হলেন। পরে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চট্টগ্রাম কলেজে থেকে আই. এ পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে বি.এ পড়তে ভর্তি হন। আর এখানেই তিনি পরিচিত হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। মূলতঃ এই পরিচয় অধ্যাপক খালেদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন নতুনভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় নিজেকে শামিল করেছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ।
তাই বিভিন্ন সময়ে জাতীয় পর্যায়ে তাঁর নানান বৈচিত্র্যময় কর্মকাণ্ড আমাদের আজও অনুপ্রাণিত করে তাঁর লেখা কবিতার মতই। ‘তপ্ত এক প্রতিজ্ঞা/ জ্বল জ্বল করছে’। জীবনের সর্বক্ষেত্রেই সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা তাঁকে সর্বজন শ্রদ্ধেয় করে রেখেছে। ‘আমি শেষ নই আমার তপ্ত অঙ্গীকারের স্ফুলিঙ্গ থেকে জন্ম নিচ্ছে আগামী দিনের জ্বলন্ত প্রত্যয়ে নবতর জীবন নির্মাণের’। কবিতার দ্বিতীয় স্তবকের মতো অধ্যাপক খালেদের জীবনও এগিয়ে গেছে স্ফুলিঙ্গের মতো।
সময়ের কারণে তিনি হয়ে উঠলেন প্রতিবাদী ও তুখোড় রাজনৈতিক নেতা। ছাত্রাবস্থায় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে পরিচিত হওয়ার যেমন সুযোগ পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খুবই কাছ থেকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাথে। এই সকল মহান নেতাদের সাহচার্যপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ নিজেকে একজন দক্ষ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে গড়ে তোলা ও প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। জীবনের এই অধ্যায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর জীবনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরীকে হারিয়ে এম.এন.এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। যা ছিল এদেশের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ায় অর্থনৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে রীতিমতো অন্য রকম সংগ্রাম করতে হয়েছে। কখনো সিএন্ডএফ ব্যবসা, কখনো ব্যাংকে চাকরি, কখনো বা স্কুলের প্রধান শিক্ষক, আবার কখনো কলেজের অধ্যাপনা।
কিন্তু স্থিতিশীল হলেন মামা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় সাংবাদিকতায়। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব তখন সাপ্তাহিক কোহিনূর নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। কিন্তু তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের। ভাগনে মোহাম্মদ খালেদের কাছে এই আকাঙ্ক্ষার কথা বললেন এবং দায়িত্ব নিতে আহ্বান করলেন। এবার মামার স্বপ্ন পূরণে নতুনভাবে সংগ্রাম শুরু করলেন। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে প্রথম প্রকাশিত হলো ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের সম্পাদনায় দৈনিক আজাদী পত্রিকা। ১৯৬২ সালে মামা ইন্তেকাল করলেন। এবার সম্পাদকের দায়িত্বে এলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। সৃষ্টি হলো আরেক ইতিহাসের।
সুদীর্ঘ একচল্লিশ বছর তিনি দৈনিক আজাদী পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যা বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক কর্মী-এই দুইয়ের সমন্বয় তিনি দক্ষতার সাথে সামাল দিতে পেরেছিলেন। যা এই প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়। ‘তারা আসছে দৃপ্ত শপথে দুর্দান্ত সাহসে ভাঙ্গতে, গড়তে শীর্ণ, দীর্ণ ব্যবস্থাকে গড়তে জীবন স্বপ্নের’। ১৯৭১ সাল। মহান মুক্তিযুদ্ধে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে আমরা পেলাম আরেক ভূমিকায়।
এবার তিনি নিজেকে সক্রিয় রাখলেন নেপথ্যের এক পরামর্শক হিসেবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন শুরু থেকেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠের সমপ্রচারের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। পরে কলকাতায় গিয়ে বালিগঞ্জে স্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও স্থাপিত হলে, দেশ স্বাধীন না হওয়া অবধি পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নতুন প্রজন্মের বীর মুক্তিযোদ্ধা, তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন ভাবে মানসিক সহায়তা ও উদ্বুদ্ধ করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।
এই সময়ে অধ্যাপক খালেদের অনুষ্ঠান পরিচালনায় নানান পরামর্শ বিভিন্ন সময়ে সেই সময়ের তাঁর সতীর্থদের কাছে জানা যায়। নতুন বাংলাদেশ গড়ায় তাঁর ভূমিকা, নবপ্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছেন। যার আরেকটি উদাহরণ ও স্মরণীয় অবদান হলো- স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। বরাবরই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থা রাখতে পেরেছিলেন।
‘আমি শেষ নই আমি শুরু নই। তারা আসছে হল্লা করে আসছে ঝাণ্ডা নিয়ে আসছে সত্য ন্যায় ও নীতির’। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ রচিত এই কবিতার শেষাংশ প্রচণ্ড আশা জাগানিয়া। যিনি সারাজীবন সততার সাথে বসবাস করেছেন, তিনিই তো এমন সুন্দর স্বপ্ন ও আশা আগামী প্রজন্মের মাঝে দেখতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সভা-সমাবেশ এমনতর আহ্বান জানিয়ে বক্তৃতা দিতেন। তিনি বরাবরই আস্থা রেখেছেন নতুন প্রজন্মের প্রতি। নতুনদের তিনি বরাবরই স্বাগত জানিয়েছেন। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন ও বীজ বপন করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম মানুষটি হলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তাঁর লিখিত একটি মাত্র কবিতায় সেই দিকনির্দেশনা আমরা পাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংস্কৃতিকর্মী












