অনুবাদ: এমদাদ রহমান
প্রথম পর্ব
[হিস্পানি ভাষার কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা’র এই লেখার বিষয় মূলত- স্মৃতি; কবির নিজের আত্মাকে ফিরে দেখার কথা। লেখাটি হিস্পানি’তে ‘লা ভিদা দে গারাসিয়া লোরকা, পোইয়েতা’ শিরোনামে হোশে লুনা’র একটি প্রবন্ধের অংশবিশেষ, যাকে ক্রিস্তোফার মোরের ইংরেজিতে ‘দ্য লাইফ অভ গারসিয়া লোরকা, পোয়েট’ এই শিরোনামে ‘গভীর গান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ স্মৃতিকথামূলক গদ্য হিসেবে স্থান দিয়েছেন; মোরের এই কথাটিও জানাচ্ছেন- এই লেখাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারের গদ্যরূপ। ১৯৩৩ সালের ১৬ অক্টোবর বুয়েন্স আইরেসে ‘কীভাবে একটি নগরী গান গাইতে থাকে, নভেম্বর থেকে নভেম্বরে’ শীর্ষক বক্তৃতায় লোরকা বলেছিলেন আজ আমি সেই ছেলেটির মতো, কোন উৎসবের জন্য নিজের মাকে রঙিন সাজে সাজতে দেখে যে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে আমি আপনাদেরকে একটি নগরীর কথা বলব, যেখানে আমি জন্ম নিয়েছিলাম। তার নাম গ্রানাদা। আর গ্রানাদা’র কথা বলতে গিয়ে আমি এই নগরীর সঙ্গীতের বিভিন্ন উদাহরণ দিব। আমি গানগুলো গাইবও। … গারসিয়া লোরকা’র জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়, ৫ জুন ১৮৯৮ সালে। কবির গ্রামের নাম ফুয়েন্তে ভাকুইরোস। ১৯ আগস্ট ১৯৩৬-এ মর্মান্তিক মৃত্যু হয় কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা’র। সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবেরতি, হুয়ান রামোন হিমেনেথ এইসব দুনিয়াখ্যাত মানুষ ছিলেন তাঁর বন্ধু। জিপসি-গীতিকা, গভীর গানের কবিতা, গীতিমালা, নিউইয়র্কে কবি ইত্যাদি তাঁর কবিতার বই। আর রয়েছে বেশ কিছু নাটক, যেমন রক্তবাসর, ইয়ারমা, বারনারদা আলমা’র বাড়ি।]
আমার জীবন? জীবন বলতে যা বোঝায়, তা কি আমার ছিল? আমার নিজেকে এখনও একটি শিশু ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ছেলেবেলার আবেগ অনুভূতিগুলি এখনও আমার ভিতর প্রবলভাবেই বর্তমান, আমি তাদের কোনোভাবেই ত্যাগ করতে পারিনি। নিজের জীবনের কথা বলতে গেলে, বলতে হবে; আমি আসলে কে? যে-কারোরই জীবন হল বেঁচে-থাকবার-কালে, কী কী ঘটেছে; তার-ই বৃত্তান্ত বা উপাখ্যান। আমার সঞ্চয়ের সমস্ত স্মৃতিই, এমনকি আমার শৈশবের সূচনা থেকেই, যা যা ঘটেছে, এখনও তীব্রভাবে জেগেই আছে।
আমি আমার শৈশবের স্মৃতি সম্পর্কেই এখানে বলছি। এই স্মৃতিগুলো একান্তই আমার একার, এত প্রগাঢ় আর গোপনীয় যে, আমি এই স্মৃতিগুলোকে নিয়ে কখনই কিছু বলতে চাইনি। আলাপ করতে চাইনি। কখনই চাইনি এগুলোকে নিয়ে কোনও বিশ্লেষণে যেতে।
আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। দুনিয়ার সমস্ত শিশুর মত, প্রত্যেকটি জিনিস, আসবাবপত্র, লতাগুল্মবৃক্ষ আর পাথরগুলো, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল আমার কাছে। তাদের পৃথক সত্তাগুলোকে শ্রদ্ধা করতাম। অবিরাম কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। জীবনের সূচনাকাল থেকে তাদের সঙ্গে আমার কতই-না কথা হল আর তাদের কী তীব্র ভালোই না বাসতাম। আমাদের বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটি পপলার গাছ ছিল, এক ঘোরগ্রস্ত বিকালে আমার মনে হল, কাল কাল এই পপলারগুলো গান গাইছে! বাতাস প্রবল বেগে যখনই গাছগুলোকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে পপলারদের গান পাল্টাচ্ছে সুর, পাল্টাচ্ছে তাল, লয় আর হতবিহ্বল আমি, ভাবছি; এই তো সঙ্গীত, হৃদয়ের অন্তঃস্থ সঙ্গীত। পপলার বৃক্ষদের গান শোনার সহগামী হয়ে পড়েছিলাম, দিনের বড় একটি অংশ চলে যেত তাদের গান শুনায়।
আসলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একদিন, আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম, যখন শুনতে পেলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে ‘ফে… দে… রি… কো’… তাকাচ্ছি চারপাশে। না, কেউ নাই, কাউকে দেখছি না। কে এমন শব্দ করে ডাকল? অনেকক্ষণ পর আবার সেই ডাক… আমার উপলব্ধি হল এই প্রাচীন পপলারদের শাখাপ্রশাখাগুলো বিপুল বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে, পরস্পরকে আলিঙ্গন করছে বিষণ্নভাবে।
আমি এই মাটিকে ভালবাসি। আমার অনুভূতিগুলো এই মাটির সঙ্গেই আমাকে কড়িকাঠের মতো বন্ধনে জড়িয়েছে, আটকে রেখেছে।
প্রায় বিস্মৃত শৈশবস্মৃতিগুলোর সবই হল মাটি-পৃথিবীর মৃন্ময় স্বাদ উপলব্ধির। এই পৃথিবী আর এই পৃথিবীর গ্রামগুলোই, আমার জীবনকে বারবার মহৎ সব অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কীটপতঙ্গ আর প্রাণিগুলো আর পাড়াগাঁর লোকজন ছিল আমার কাছে সব সময়ের এক অতি ব্যঞ্জনাময় বিষয়। হয়ত, গ্রামের লোকজনের ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তিগুলোই যেন আমার জীবন-চেতনাকে আত্মিকৃত করে নিয়েছিল সুদূর শৈশবে। আর, যদি তা না-ই হতো রক্তবাসর বইটি আমার পক্ষে তাহলে কোনকালেই লিখে ওঠা সম্ভব ছিল না। মৃন্ময়কে ভালবাসা, পৃথিবীকে ভালবাসা আমার ভেতরের শৈল্পিক অভিজ্ঞতা লাভের মূল বীজটি রোপণ করেছিল।
এটা হল বাস্তবতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তরূপে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে কোনকিছুর অকপট বয়ান। সময়টা ছিল সম্ভবত ১৯০০ সাল। আমার স্বদেশ, যে-দেশটি ছিল কৃষকদের কৃষিজমিগুলোর মাটি চষা হত এমন এক ধরণের লাঙল দিয়ে, যে-লাঙল কায়ক্লেশে মাটির খোলসটাকে খুঁড়তে পারত নামমাত্রই। সেই বছর কয়েকজন চাষি তৈরি করল একেবারে আনকোরা ‘বাবান্তি’ লাঙলের ফলা- এই নামটি আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল এই তেজস্বী বলবান লাঙলের ফলা ১৯০০ সালের প্যারিস এক্সিবিশনে পদক লাভ করেছিল। ছোট্ট বালক হিসাবে আমার ছিল প্রচণ্ড কৌতূহল। বালকের উৎসুক্য নিয়ে আমি দেখতাম জমির পর জমির মাটি কী প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় খুঁড়ে চলেছে নতুন লাঙলের চতুর ফলা!
আমার দেখতে ভাল লাগত কীভাবে অগুন্তি ইস্পাতের ফলা খুঁড়ে চলেছে পৃথিবীর বুক আর তার গভীর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছে নানান শিকড়বাকড়, মনে হত, না, শিকড় নয়, যেন মাটির আত্মা থেকে বের হচ্ছে রক্ত আর মাঝেমাঝে শক্ত কিছুর সঙ্গে লেগে পেরে না উঠে আটকে যাচ্ছে ফলার দুর্বার গতি। ঘর্ষণে উজ্জ্বলিত ইস্পাতের ফলা মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে বহুবর্ণ-পাথর-শোভিত রোমান মোজাইকের একটি খণ্ড, তাতে খোদাই করা দুইজন মানুষের নাম… আজ আমি এই ব্যাপারে আর কিছুই মনে করতে পারছি না, তবে, আবছা মনে পড়ছে; নাম দুটি ছিল মেষপালক দাফনিস আর কোলী’র। বিষয়টার গুরুত্ব এইখানেই যে এখান থেকেই আমার জীবনের প্রথম শিল্প-উপলব্ধি হল বিস্ময়কর। বুঝতে পারলাম শিল্প আর সুন্দর সম্পর্কিত মাটির সঙ্গে। খোদাইকৃত এই নাম দুটি দাফনিস আর কোলী ছিলেন ভূমিপুত্র, পৃথিবীর স্বাদকে তারা আস্বাদন করেছেন আর জীবনের সঙ্গে জড়িয়েছেন; প্রেমময় সম্পর্কের বন্ধনে। আসলে, এইসব উপলব্ধি হল আমার ভিতর জেগে ওঠা প্রথম অনুভূতি, যা খুব দৃঢ়ভাবেই ভূমির সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ, মাঠঘাটে দিনমান কাজ করার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার নিজের সঙ্গে এই কথাটাই বলতে চাই যে আমি হলাম কৃষক আর জমিজমা বিষয়ক জটিলতায় আক্রান্ত এক মানুষ, যেমনটা মনঃসমীক্ষণবিদরা, বলে থাকেন। মাটির প্রতি এই ভালবাসা ছাড়া আমার পক্ষে কোনভাবেই দ্বিতীয় কাজটি, ইয়ারমা, শুরু করতেই পারতাম না। আমার কাছে মাটি হল দীনতা, দারিদ্রতার এক প্রগাঢ় ইঙ্গিত, আমি দারিদ্রতা ভালবাসি, সবকিছুর উর্ধ্বে বসিয়ে রাখি; কিন্তু এই দারিদ্রতা শোচনীয় বুভুক্ষা নয়; মহিমান্বিত, বিনীত, বিবর্ণ পাউরুটির মত সরল…












