পাঁচ বছর বয়সী সিলা আবু আকলান গভীর মনোযোগ দিয়ে তার নতুন কৃত্রিম পায়ে হাঁটার অনুশীলন করছিল। ছোট্ট পায়ের নিচে গোলাপি রঙের স্নিকার, উপরে লেসের সাজানো সুন্দর ফ্রিল, যা তার গোলাপি হুডির সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৫ মাস আগে ইসরায়েলের এক বিমান হামলায় তার ডান পা গুরুতরভাবে পুড়ে যায়। পরে তা কেটে ফেলতে হয়েছিল। অবশেষে সে একটি কৃত্রিম পা পাচ্ছে। গাজার চলমান যুদ্ধের সবচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্যগুলোর একটি হলো হাজার হাজার শিশুর হাত–পা হারানোর ঘটনা।
সিলার মা–বাবা ও বোনেরা ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিমান হামলায় নিহত হন। সিলার পা মারাত্মকভাবে পুড়ে গিয়েছিল। এক মাসের চিকিৎসার পরও উন্নতি না হওয়ায় তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করত সে, বলছিল তার খালা ইয়াসমিন আল–ঘোফারি। শেষমেশ ডাক্তাররা তার হাঁটুর ওপর থেকে পা কেটে ফেলতে বাধ্য হন। আমি তাকে যতটা পারি আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সত্যি বলতে এটা সম্ভব না। ব্যথা তো ব্যথাই, পা না থাকা মানে তো পা না থাকাই, বলছিলেন আল–ঘোফারি। সিলা যখন অন্য মেয়েদের খেলতে দেখে, সে তার ওয়াকার ব্যবহার করে দৌড়াতে চায়, কিন্তু পড়ে যায়। তখন সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি কেন এমন? আমি কেন ওদের মতো নই?
১১ বছর বয়সী রিমও এক বিমান হামলায় তার হাত হারিয়েছে। সে এখন নিজে কাপড় পরতে পারে না, চুল আঁচড়াতে পারে না। এমনকি জুতা বাঁধতেও পারে না। তার মা বলছিলেন, যখন কেউ সাহায্য না করতে পারে, তখন সে রেগে গিয়ে ভাইবোনদের আঘাত করে। আবার কখনো একা একা বসে থাকে, চুপচাপ অন্য শিশুদের খেলতে দেখে। একদিন রিম তার বাবাকে বলেছিল, সে মরে যেতে চায়। আরেকদিন পরিবারের মধ্যে মাংস নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। রিম হেসে বলেছিল, আমাকে একটা ভেড়ার মতো জবাই করো।
২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত গাজায় প্রায় ৩–৪ হাজার শিশু হাত বা পা হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ জামাল আল–রোজি ও হুসেইন আবু মনসুর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, প্রায় ১৭,৫০০ শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন, যাদের পুনর্বাসন ও সহায়তা প্রয়োজন। যুদ্ধের সময় হাসপাতালগুলোতে সাধারণ সংক্রমণও চিকিৎসা করার মতো ওষুধ ছিল না। ফলে অনেক শিশুর হাত–পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫ হাজার শিশু ছিল ছয় বছরের নিচে। ৮৭৬ জন ছিল এক বছরের কম বয়সী। এই অভিযানে মোট ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ১৩ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। গাজার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ বাস্তুচ্যুত এবং শহরের বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।
যুদ্ধবিরতির সময়ে কিছু সাহায্য গাজায় প্রবেশ করেছিল। তা মোট চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ পূরণ করতে পেরেছে বলে জানিয়েছে মেডিক্যাল এইড ফর প্যালেস্টাইন। তবুও হাজার হাজার শিশু কৃত্রিম অঙ্গ, হুইলচেয়ার, ক্রাচ এবং পুনর্বাসনের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে যে পরিমাণ সহায়তা প্রয়োজন, তা এখনো খুবই সীমিত।
গাজার কিছু শিশুকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। তবে চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে বের হওয়ার গতি ধীর। প্রতিদিন মাত্র কয়েক ডজন রোগী যেতে পারছে। গত সপ্তাহে ইসরায়েলের হামলার পর সেই সংখ্যাও আরও কমে গেছে। এখনও প্রায় ১৩ হাজার রোগী গাজা ছাড়ার অপেক্ষায় আছে, যারা একটু সুস্থতার আশায় দিন গুনছে।
একজন মায়ের আর্তনাদ : আসমা আল–নাশাশের একটাই চাওয়া, তার ১১ বছর বয়সী ছেলে আব্দুর রহমান যেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারে এবং একটি কৃত্রিম পা পায়। তিনি বলেন, একটি জাতিসংঘ স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্রে রূপান্তরিত করা হয়েছিল, সেখানে একটি ছোট দোকানে রহমান জিনিসপত্র বিক্রি করছিল। তখনই বিমান হামলা ঘটে। বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষ তার পায়ের মধ্যে বিদ্ধ হয়। ডাক্তাররা সেটি রক্ষা করতে পারেননি। তখন থেকে সে একা বসে মায়ের ফোনে গেমস খেলে। কারণ সে আগের মতো ফুটবল খেলতে পারে না।
অন্য শিশুরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে, এক পায়ের ছেলে বলে ডাকে। আসমা বলেলন, যখন দেখি আমার ছেলে এভাবে একা হয়ে গেছে, আমি তার জন্য কিছুই করতে পারছি না, তখন আমার হৃদয় টুকরা টুকরা হয়ে যায়।