১৯৭১ সাল আমি তখন ছোট ছিলাম উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র। মিছিল মিটিং দেখতাম, শুনতাম। টিনের চুংগা দিয়ে সভা ডাকতো, বিভিন্ন শ্লোগান দিত, চুংগা হাতে নিয়ে বক্তৃতা দিত। মিছিলের পিছনে পিছনে দৌড়াতাম। দেশে কী হচ্ছে, কেন গোলভাল হচ্ছে, কী আমাদের চাওয়া পাওয়া মোটেও তেমন বুঝতাম না। বছরের তৃতীয় মাস মার্চ মাস বাঙালির জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় মাস, একটি ঐতিহাসিক মাস, শোকের মাস, বাঙালির আত্ম পরিচয়ের মাস, বিশ্বে নতুন নামে বির্নিমাণের মাস নতুন মান চিত্রের মাস। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র থেকে বেড়িয়ে আসার মাস। সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ফিরে পাওয়া মাস। ১৯৪৭ থেকে অনেক ঘটনা ইতিহাস রচিত হলো। শুরু হলো দলমত নির্বিশেষে নিজেদের মধ্যে আলোচনা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭ মার্চ‘ ৭১ সব কিছু উপেক্ষা করে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্ববৃহৎ জন সভার ডাক দিলেন এবং সকলের মিলে হাতে হাত রেখে গ্রামে গঞ্জে খবর পৌঁছে দিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন চার খলিফাখ্যাত দক্ষ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। এই চার নেতা বঙ্গবন্ধুকে বার বার চাপ সৃষ্টি করছিলেন তাঁরা বললেন আজকেই ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতেই হবে। বঙ্গবন্ধু গম্ভীর হয়ে তাঁদের বললেন মুজিব জানে কখন কোথায় কী বলতে হবে। সেইদিন সকালে থেকে সমগ্র বাংলাদেশে সকল মানুষের মনে দারুণ উৎসাহ উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হলো। রেডিও নিয়ে সকলে বসে বসে শুনছে লক্ষ লক্ষ জনতার আগমনে রেসকোর্স ময়দান জন সমুদ্রে পরিণত হলো হাতে ছিল হাজার হাজার লাঠি। সেই জন সমুদের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। সেই ঐতিহাসিক ময়দানে যাওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন বক্তব্যে কী বলবো। সেই বাংলার বঙ্গমাতা কোনও চিন্তা না করে বলে দিলেন তোমার মুখে যা আসে তাই বলে দিও। কারণ পেছনে রাইফেলের গুলি সামনে বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতার মত খুব সুন্দর সাজানো গুছানো ১৯ মিনিট বক্তৃতায় জনতা কথা, অত্যাচারে কথা,দেশের কথা, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কথা, স্বাধীনতার কথা বললেন। বাঘের মত গর্জে উঠলেন। সেইদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির রক্ত টকবকে হয়ে উঠেছিল। বাংলার ইতিহাসের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার কণ্ঠে পরিষ্কার নির্দেশনা পেয়ে মুগ্ধ বাংলার জনগণ এবং তিনি বললেন যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। তখনই বাংলার আপামর জনসাধারণ মন স্থির করে মানসিক প্রস্তুতি শুরু করলেন। বাঙালিরা একত্রিত হতে দেখে বাংলার বেঈমান বিশ্বাস ঘাতকরা স্বৈরাচারীর কাছে খবর পৌঁছে দিল। শুরু হলো আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ধরপাক নির্যাতন বর্বরতা। এতে করে বাঙালিরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। শেখ মুজিবুরের নির্দেশ মত অফিস আদালতে নিয়ম শুরু হলো। কোন ভাবেই যখন বাঙালিদের দমন করা যাচ্ছে না শেষ পযর্ন্ত উপায় না দেখে পাক বাহিনী ২৫ মার্চ‘৭১ দিবাগত কালোরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। নির্মমভাবে গণহত্যা চালিয়ে যায়। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হলে, পুলিশ ব্যারাক, ঢাকা বিভিন্ন স্থানে, ঘুমন্ত মানুষের ওপর নির্মম নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। স্বৈরশাসক বার্তা পাঠালেন পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ চাই না, মাটি চাই। চালানো হলো লুটপাট, অগ্নিসংযোগ কেউ রেহাই পায়নি প্রত্যেকে কিছু না কিছু হারিয়েছে। রাতের আধারে মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেলেন। অমানবিক অত্যাচারে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা সেবা সবই করেছেন এবং দামাল ছেলেদের ট্রেনিং দিয়ে অস্ত্র দিয়ে আমাদের দেশে প্রেরণ করেন সঙ্গে ভারতে সেনাবাহিনীও দেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে হাতে হাত মিলিয়ে দেশকে বাঁচাতে, মা বোনদের বাঁচাতে, ইজ্জত রক্ষা করতে দামাল ছেলেরা ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধ (সেই অনেক ঘটনা)। নয় মাস যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ হলো, দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা গর্ব করি বাঙালি হিসেবে। তাইতো ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করি। বিশ্বে নতুন মান চিত্র এনে দেওয়া উজ্জ্বল নক্ষত্র মহামানব আমাদের অহংকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর এবং পরিবারের বিদেহী আত্মার প্রতি লাল সালাম জানাই।