প্রথমত, নির্মল ও উদাত্তকণ্ঠে সুর মিলিয়ে সবাই যখন গেয়ে উঠি ‘ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’- তখন সকল সংকীর্ণতা যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে যায়। কী যে প্রশান্তি এই সুরে! পৃথিবীর জাতীয় সংগীতের মধ্যে মনে হয় আমার জাতীয় সংগীতই শ্রেষ্ঠ। যেমনি কথা তেমনি সুর।এরপর একটু দৃশ্যপট বদল! লিখেছেন’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘। এবার মনের মণিকোঠায় একটু খচখচ করে ওঠে। যারা সকল সংকীর্ণতার উর্ধ্বে বলে নিজেকে জাহির করেন, তারাও নড়েচড়ে বসেন। কিছু বলতে গিয়েও আটকে যান। সত্যি বলতে কী সংকীর্ণতা বা হীনমন্যতা জাতির মধ্যে রয়েই গেছে।
দ্বিতীয়ত, যে জাতির গুণকীর্তন করে আমরা বিশ্ব দরবারে মর্যাদা লাভ করেছি- কখনো ভাষা আন্দোলন, কখনো স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা গর্ব করে বলেছি আসলেই আমরা কী এক জাতি, এক প্রাণ হতে পেরেছি? নিজ প্রয়োজনে ‘দেশ’, ‘জাতি’ এসব শব্দ ব্যবহার করছি বটে কিন্তু সংকীর্ণতার বেড়াজাল থেকে বের হতে পারিনি।’বাবা’ কে বাবা’ বলতে যে সন্তান কুণ্ঠাবোধ করে তেমন সন্তানের সাহায্য সহযোগিতা ঐ সংসারে প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা। একটা জাতির জন্ম হল। আর এর জন্য যিনি সংগ্রাম করে গেছেন তাঁকে সম্মান তো দূরের কথা তাকে অকপটে অস্বীকার করা হচ্ছে। আমি বা আমরা তখনো জন্মগ্রহণ করিনি। আমরা বুঝতে পারছিনা কত ত্যাগ স্বীকার, কত রক্ত ঢালা হয়েছে এই জাতি বিনির্মাণের পেছনে।অথচ সেই আমরাই এখন অন্যের শেখানো বুলিতে বড় বড় কথা বলে যাচ্ছি।নিজেদের বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা বিসর্জন দিয়েছি।পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে ‘জাতির পিতা’- নিয়ে বিতর্কিত এ হীনকর্মকাণ্ড আছে বলে মনে হয়না।যে জাতির মধ্যে এখনো একাত্মতা আসেনি, সে জাতি আবার গর্ব করে কী নিয়ে?
পরিশেষে—-পিতাকে সম্মান করা বা না করা যার যার ব্যাপার,তাই বলে কী পিতার গায়ে হাত তোলা যায়? পিতাকে আঘাত করা যায়? পিতার সমস্ত অংগ খুঁচিয়েখুঁচিয়ে রক্তাক্ত করা যায়? এরা কোন মায়ের সন্তান?? প্রতিশোধের এ কোন বিভৎস পদ্ধতি! এ সন্তানদের কর্মকাণ্ড শুধু একটি দৃশ্যই স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীদের। যাদের বেয়নটের খোঁচায় রক্তাক্ত হয়েছিল আমাদের মা- বাবা, ভাই- বোন আরো অজানা কত প্রাণ! আমরা সমস্বরে জাতীয় সংগীত গাইতে পারি কিন্তু একটি জাতি গঠনে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তাকে সমস্বরে “জাতির পিতা” বলতে দ্বিধাবোধ করি। আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা মর্যাদাপূর্ণ পদে আসীন হয়েছি। প্রাণ ভরে বলছি আমি স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। কিন্তু স্বাধীনতার মূল শক্তিকে স্বীকার করার মতো শিক্ষা হয়তো লাভ করিনি। মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম যথার্থ বলেছেন- এ বঙ্গে জন্মে যে বঙ্গভাষা অস্বীকার করে, সে এদেশ ত্যাগ করে অন্যদেশে যাচ্ছেনা কেন? আসলেই আমাদের দেশ বাংলাদেশ। প্রকৃতির সমস্ত রূপ-রস দিয়ে গড়া এ দেশ।আমরা সবাই এ দেশকে ভালবাসি। আমরা গর্ববোধ করি এ দেশে জন্মে। তাই দেশমাতৃকার প্রতি বিনম্র ও সদয় হয়ে আমরা পারস্পরিক কোলাহল বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ভূমিকা রাখতে পারি!