ছোট বেলায় প্রায় একটা পদ্যের লাইন শুনতাম; ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। কী সরল একটা আবেদন। সতেরশ শতকে একজন কবির (ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর) প্রার্থনায় অনেক বিষয়ের সাথে সন্তানের জন্য এই রকম সরল ও আবেগী একটা আবেদন ছিল। কয়েক শত বছর পার হয়ে গেল। শতাব্দী ডিঙিয়ে একবিংশ যুগে প্রবেশ করেছি। এখনো কবির সেই আবেদন অনেক মায়ের প্রার্থনায় থাকে। যদিও নিদারুণ শঙ্কা নিয়ে বর্তমান প্রজন্মকে মা বাবারা লালন করছে। দুধভাতের স্থলে নিরাপদ জীবনটা বড় একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একসময় আক্ষেপ করতাম মানুষ কেন দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য এত মরীয়া! নিজের দেশের মাটি আর আলো বাতাস ছেড়ে কীভাবে দূরদেশে পাড়ি জমায়? এই প্রথাগত ভাবনায় আঁকড়ে থেকে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কখনো দেশ ছাড়ার কথা মাথায় আনিনি। সন্তানদেরও সেই মানসিকতা নিয়ে বড় করেছি। কিনু্ত ৩/৪ বছর থেকে বার বার মনে হচ্ছে জীবনের অনেক ভুল সিদ্ধান্তের মাঝে এটা অনেক বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো দেশের প্রতি আস্থা আর ভালোবাসা। ২০২৪ সালে ৫ আগস্টের পর নতুন আশায় বুক বেঁধেছিলাম। সেই আশাটা ক্রমশ ফিকে হয়ে এসেছে। অপেক্ষায় থাকা আমার মত অনেক মায়েরা এখন হতাশাগ্রস্ত। জুলাই আন্দোলনকে প্রথম দিকে খুব বেশি প্রাধান্য দিইনি। আবু সাঈদকে মারার দৃশ্যটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে চোখ রেখেছি নিউজে, সোশ্যাল মিডিয়ায়। ঠিকমত খাওয়া হতো না, ঘুম হতো না। সকালে রিমোট হাতে বসে যেতাম টিভিতে নিউজ দেখতে। মনঃপুত না হলে সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করতাম। বিগত ২০ বছরে যত বাংলাদেশী চ্যানেলে নিউজ দেখেছি তার বেশি মনে হয় ১৫ জুলাই, ২০২৪ থেকে পরবর্তী ২/৩ মাসে দেখেছি। ছেলে মেয়েগুলোর জন্য আকুল হয়ে কাঁদতাম। দেশের ভালোর জন্য রোজা রেখেছি। নিজের ছেলেকে নিয়ে সহায়তা করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষিত, কম শিক্ষিত, গৃহবধূ থেকে কর্মজীবী মায়েরা জুলাই আন্দোলনে নানা ভাবে সংযুক্ত ছিলো। বাবারা তো ছিলই।
কিন্তু বিগত কয়েকমাসে যা দেখছি তাতে খুবই হতাশাগ্রস্ত আর শঙ্কিত। ছেলে মেয়েকে বলছি তোমরা দেশ ছাড়ো। নিজের মত করে ভালো থাকো। রাজনৈতিক বলি, মিথ্যা অপবাদ, ক্ষমতা লিপ্সুদের কদাকার হাতের থাবা থেকে বাঁচার জন্য খোদার কাছে প্রার্থনা করি। এই দেশের মানুষ এখন নিপীড়িত। দাবার গুটির মত এরা নানা ভাবে ব্যবহৃত হয়। জীবন জীবিকা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব দেখার মত আগেও কেউ ছিলো না, এখনও কেউ নেই। জনগণকে শুধু প্রয়োজন আন্দোলনে, সমাবেশে আর ভোটকেন্দ্রে। এরপর এদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় কারো হয় না। ক্ষমতালিপ্সুদের হাত থেকে মুক্তির কোনো উপায় নেই। এদেশের জনগণ যেন ক্ষমতার দুষ্টচক্রে বন্দি হয়ে গেছে। আশাবাদী মানুষেরাও উত্তরণের কোনো উপায় দেখছে না। শঙ্কিত মা বাবার একটাই ভাবনা ‘আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদে’।