আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক

জোনাকী দত্ত | মঙ্গলবার , ২৫ মার্চ, ২০২৫ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

আমার একটি সুন্দর শৈশব আছে যা বলতে আমি খুব আনন্দ পাই। বড় হতে হতে দেখেছি লালদিঘির টলমলে জল, বাগানে হরেক রকমের ফুল এবং একজন কড়া মালী (প্রায়শ ফুল ছিঁড়তে তার বকা শুনেছি, কান মলা খেয়েছি)। প্রজাপতির পেছনে ছুটেছি, দিঘির জলে সাঁতার কাটা, ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে নতুন ক্লাসের নতুন বই কেনার জন্য জ্যাঠামশায়ের সাথে আন্দরকিল্লা পাঠকবন্ধু লাইব্রেরিতে যেতাম। বার্ষিক পরীক্ষার পর মামাবাড়ি নোয়াপাড়া যেতাম, মহামুনি পাহাড়তলীতে মেলায় নাড়ু, মোয়া খেয়ে ঘুরে বেড়াতাম।’ বলছিলাম আমার প্রিয় শিক্ষক, শুভাকাঙ্ক্ষী রীতা দত্ত দিদিমণির কথা। তিনি তাঁর শৈশবের বর্ণনা এভাবে করেছেন।

তিনি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, পটিয়া সরকারি কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। দীর্ঘ দশ বছর এনায়েত বাজার মহিলা কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। অবসরে গিয়ে পতেঙ্গা মহিলা কলেজে যোগদান করেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতেন। বর্তমানে তিনি শিশু শিক্ষায় তাঁর জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘শিক্ষকদের কোনো অবসর নেই। একজন শিক্ষক অবিরাম ছাত্র। একজন যথার্থ শিক্ষক সবসময় জ্ঞান সাধনায় ব্রতী থাকবেন।’ রীতা দত্ত দিদিমণি আমার কলেজ জীবনের শিক্ষক। তিনি যখন যুক্তিবিদ্যা পড়াতেন তখন মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথাগুলো শুনতাম। তাঁর কণ্ঠে এমন আকর্ষণ আর মাধুর্য ছিল যে পুরো ক্লাস নীরব হয়ে যেতো। একজন সাদাসিধে পোশাকের, হালকা পাতলা গড়নের মানুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে শুভ্রতার স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

অনেক বছর পর তাঁর সাথে আমার দেখা হয় ২০১২ সালে, প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাতী শাখায় যখন আমি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। আমি একজন তাঁর ছাত্রী পরিচয় দেওয়ার পর তিনি আমাকে সানন্দে গ্রহণ করে নিলেন। তখন তিনি আমাদের অবৈতনিক প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। তিনি প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষা কমিটিতেও ছিলেন। তাছাড়া তিনি প্রবর্তক সংঘের আজীবন সদস্য। তিনি চট্টগ্রাম সারদা সংঘেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছেন। বর্তমানে তিনি বিবেকানন্দ স্কুলে যুক্ত আছেন এবং প্রবর্তক সংঘে তিন দিন কলেজ শাখার শিক্ষার্থীদের এবং প্রাথমিক শাখার শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে পড়িয়ে আনন্দ পান। বর্তমান যুগে এই রকম নির্লোভ মানুষের দেখা পাওয়া খুব দুষ্কর। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি দিদিমণির মতো মানুষের সান্নিধ্য লাভের জন্য। তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি যা আমার শিক্ষকতা পেশায় উপকার পেয়েছি।

আমার চট্টগ্রাম একাডেমিতে যুক্ত হওয়া, বই প্রকাশ, দৈনিক আজাদী পত্রিকায় লেখা প্রকাশ সবকিছুতে দিদিমণির অনুপ্রেরণা আমার সাথে থাকে। তাঁর আন্তরিক আশীর্বাদ আমার জীবনে চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে। আমার শৈলী প্রকাশন থেকে প্রথম বই প্রকাশ নিয়ে কথা বলার সময় দিদিমণি এবং আমার স্বামী ছিলেন আমার পাশে। করোনা কালীন আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সময় তিনি একাডেমিতে সবার আগে গিয়ে উপস্থিত ছিলেন যা দেখে আমার মন আনন্দে ভরে গেল। এটা আমার সবচাইতে বড় পাওয়া। আমার একটা বই দিদিমণিকে উৎসর্গ করতে পেরে আমি গর্বিত। আমার যে কোনো সাফল্যে তিনি আনন্দিত হন, অনুপ্রেরণা যোগান। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজের শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মনোজ কুমার দেবের উদ্যোগে বইয়ের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানে আমার বই নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। এই বয়সেও তিনি চমৎকার গান করেন। তাঁর বক্তৃতা এতোটাই শ্রুতিমধুর আর শিক্ষণীয় যে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শ্রবণ করে। স্কুলে তাঁকে আমরা শিক্ষকরা কোনদিন কোন উপহার দিতে পারিনি। তিনি উপহার নেওয়া একদম পছন্দ করেন না। বরং তিনি কোথাও কোন বক্তৃতায় সম্মানী পেলে আমাদের ভালো নাস্তা এনে খাইয়ে দেন। কোন বই উপহার পেলে সবাইকে বিলি করে দেন। আমাদের স্কুলে তিনি অনেক পুরস্কার হিসেবে বই দিয়েছেন সম্পূর্ণ নিজের খরচে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা কখনো তার জন্মদিন জানতে পারিনি তাই পালন করাও হয়নি। তিনি প্রচারবিমুখ একজন মানুষ। তিনি নীরবে নিভৃতে থাকতে পছন্দ করেন। এখনো তিনি তাঁর দায়িত্ব কর্তব্য আন্তরিকতার সাথে সুষ্ঠু সুন্দরভাবে পালন করেন। তাঁকে নিয়ে অনেকেই বিশদভাবে লিখেছেন। তাঁর জীবনের গভীরতা অনেক দূর বিস্তৃত। আমি সেখান থেকে সামান্য কিছু আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমার দেখা একজন নির্লোভ, নিরহংকারী, মহীয়সী নারী, আমার শিক্ষক, শুভাকাঙ্ক্ষী অধ্যক্ষ রীতা দত্ত দিদিমণির প্রতি আমি আন্তরিক শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা জানাই।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতি মাঝে
পরবর্তী নিবন্ধগান ও দর্শন চেতনায় মরমী শিল্পী হাছন রাজা