আমার যত স্মৃতিকাতরতা

ফারিহা জেসমিন ইসলাম | রবিবার , ১০ নভেম্বর, ২০২৪ at ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

তারিখটি মনে আছে স্পষ্ট; ২৫ অক্টোবর ২০১০। চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে সকাল সকাল বিভাগের দিকে ছুটলাম। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আমি এখানকার স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী। আজ আমাদের স্নাতকের রেজাল্ট হবার কথা। রেজাল্ট পেয়ে যারপর নাই নার্ভাস। কী করব বুঝতে না পেরে সবার আগে ব্যাগ হাতড়ে ভাঙাচোরা মোবাইল ফোনটা বের করে আনলাম। কী করব? বাবাকে ফোন দিলাম। হ্যালো বাবা, বাবা, আমি কথা রেখেছি। কিসের কথা? ফোনের ওপাশ থেকে বাবা বলতে থাকে। আমি বললাম, আমার অনার্সের রেজাল্ট হয়েছে, আমি তোমাকে দেয়া কথা রেখেছি বাবা। বাবা আকুল হয়ে বলল, কত পেয়েছ? ফার্স্ট হয়েছ? আমি উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, আমি ফার্স্ট হয়েছি। বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। আরেকটা কল করতে হবে আমাকে। রিং হলো, রিসিভ করছে না। আবার ট্রাই করলাম। ওপাশে আম্মা। আমি বললাম আমার অনার্সের রেজাল্ট হয়েছে। আমি ফার্স্ট হয়েছি আম্মা। আম্মা বলে উঠলো, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট? আমি বললাম, হ্যাঁ, সেটাই। ওপাশে নীরবতা। কোনো শব্দ নেই। নিমিষেই আঁচ করলাম আমার মা কাঁদছেন। পরক্ষণেই উওর পেলাম, আমার আর কিছু বলার নাই। সৃষ্টিকর্তার কাছে আম্মা হাত তুলেছিলেন কিনা আমি দেখতে পাইনি তবে আমি তুলেছি, শুকরিয়া জানিয়েছি, প্রাণপণে মানুষ হতে দোয়া করেছি। সাফল্যের এই মাহেন্দ্রক্ষণ আমার মনে সযত্নে সংরক্ষিত। এই সাফল্য বহু উত্থানপতনের সাক্ষ্য দেয়। হারতে হারতে জিতে যাওয়া একটি জীবনের বহু গল্প বলে যায়।

আমি ফারিহা জেসমিন, কারো কারো কাছে জ্যাকি। বাবা আমার পৃথিবী, মা আমার বেহেশত। পৃথিবীতেই স্বর্গ, নরকের স্বাদ পেয়েছি। প্রিয়জনদের ভালোবাসায় বেঁচে আছি। তবে বেঁচে থাকার আরেকটা কারণ আছে। আমি অনেকগুলো ছেলেমেয়ের অভিভাবক। তাদের কথা ভাবলে নিঃসন্দেহে বেঁচে থাকা পরম প্রশান্তির মনে হয়।

এর চার বছর পর, ততদিনে জীবনের বহু সত্য জেনে গিয়েছি। জেনেছি পৃথিবীতে একই সাথে সুন্দর এবং অসুন্দরের বাস। একই ভূমিতে সরল এবং গরলের চাষ। আমার বাবা অনেক কষ্টে আমাকে মানুষ করেছিলেন এবং একটা জিনিসই আমার কাছে চেয়েছিলেন; আমি যেন নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকি এবং সুযোগ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকে স্বাগত জানাই। এটাই তাঁর একমাত্র চাওয়া।

আমি আজন্ম একজন স্বাপ্নিক মানুষ। দুচোখ জোড়া স্বপ্নের বিস্তার। বড় হয়ে কী হব কেউ এমন প্রশ্ন করলে একেক সময় একেকটা হতে চাইতাম। কিন্তু শিক্ষক হবো এমন কিছু কখনো ভেবেছি বলে মনে পড়ছে না। তবে আমাকে নিয়ে বাবার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ব্যাচলর, মাস্টার্স করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে যোগ দিলাম ২০১৪ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখে। শুরু হলো এক নতুন পথ চলা। আলোর পথে আমার গন্তব্যে আমি হেঁটে চলেছি নিবিষ্টচিত্তে।

৯ নভেম্বর ২০২৪। এই যাত্রা দশম বর্ষ ছুঁয়েছে। আমার বাবার সার্থক স্বপ্ন। আমার সামগ্রিক জীবনের অভিজ্ঞতা তেমন সরল না হলেও দীর্ঘ দশ বছরের শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা খুব সুন্দর।এখন মনে হয় আমি শিক্ষকই হতে চেয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, আমার জ্ঞান সাধনার তীর্থ, এখানেই জীবন, এখানেই জীবিকা। এখানেই স্মৃতি, এখানে বসতি। আনন্দহতাশা, বিস্তারসমাপ্তি সবকিছুর কেন্দ্রস্থল এই বিদ্যাপীঠ। নিজ বিভাগে শিক্ষকতার দশ বছর পূর্তিতে আমি পুলকিত, আমি আবেগে আপ্লুত।

বর্তমানে শিক্ষকতা ছাড়াও বিশ্বায়ন, প্রবাসী নারী শ্রমিকের মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করছি ও লিখছি এবং উচ্চতর পাঠ নিচ্ছি মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ে থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার এই যাত্রায় সবার দোয়া চাই। আমার বাবামা, আমার শিক্ষকদের প্রতি অনিঃশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

সঙ্গতকারণেই শিক্ষকতা এবং শিক্ষকদের জন্য আমার অনুভব আলাদা। শৈশব থেকে আমার বেড়ে ওঠার পেছনে শিক্ষকদের ভূমিকা বাবা মা’র চাইতে কোনোভাবেই কম নয় বরং বেশিই। অন্তরের পরম পূজ্য স্থানটা আমার সেই সব শিক্ষকদের জন্য যাদের কারণেই আমার আজকের অবস্থান। তাঁরা যে যেখানেই আছেন আমার অতল শ্রদ্ধা তাঁদের জন্য। আমি তাঁদের পথ অনুসরণের চেষ্টা করে যাই সবসময়।

এই দীর্ঘ সময়ে হারানো এবং পাওয়ার তালিকা নেহায়েত ছোটো নয়। তারপরও আমি অনেক খুশি। সময় ক্ষতবিক্ষত করে, সময় আপনজন কেড়ে নেয়, সময় কাঁদায়। এই সময়ই আবার বাঁচতে বলে, শূন্যস্থান পূরণ করে। যে জীবনে সংগ্রাম নেই সেই জীবনের প্রাপ্তিগুলো আনন্দের হয় না। শান্ত, নির্জীব ঢেউহীন সমুদ্র আমাকে আর বিমোহিত করে না। আমি লড়াই করে বাঁচি, আমি আনন্দে বাঁচি। আমি মনে করি সে মানুষ সবচে দরিদ্র যে তার শিক্ষককে সম্মান করে না, মনে রাখে না। শিক্ষকতাকে পেশা বলার চেয়ে ব্রত বলাই আমার পছন্দ। এই মহান ব্রতের জয় হোক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজার দর
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে