রোজার ছুটিতে বহুদিক ভ্রমণের পর মা আমার বাসায় এসেছে দুদিন হল। মা গুনতে থাকে চারদিন…পাঁচদিন। কিন্তু আমার মনে হয় এইতো এলে। মাএলে আমার ভোর হয়। দিনমান দীর্ঘ হয়। মনে হয় আমার ভুবনে আলো আর আলো। এমনিতে আমি বেশিরভাগ সময়ই অন্ধকারে থাকি। আমার জীবনে গোধূলি আসে, তারপর সায়াহ্ন। ওই অতটুকু গোধূলি আলোতেই আমি আমার বেঁচে থাকার স্বাদে অটল থাকি। আলো হাতরে বেড়াই। কিন্তু মা এলেই আমার চারদিকে সূর্যোদয় হয়। দেহে মনে প্রাণে আমি অনন্য শক্তিধর হয়ে যাই । আমার কাছে অনন্ত আলোকের আধার আমার মা, অফুরন্ত শক্তির সম্ভার আমার মা। ছোট থেকেই মায়ের আদর থেকেও শাসনটা এত বেশি পেয়েছি যে মায়ের বুকে আছড়ে পড়তে বা মা কে জড়িয়ে ধরতে এখনো সঙ্কোচ বোধে আড়ষ্ট হয়ে থাকি। এ কদিনে কতবার ইচ্ছে হয়েছে, আমার ছোট্ট শিশু কন্যার মত করে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরি, মাকে একটু আদর করি, কিন্তু মায়ের প্রতি কোন যে সে এক ভয়, পাছে আবার মুখ ঝামটা দেয়, সেই ভেবে আর করেই উঠতে পারি না মাকে আদর। সব সয়ে নেয়ার ক্ষমতায় মা এখনো অটল। এটুকু ক্ষমতাই আজো আমি আয়ত্ত করে উঠতে পারলাম না। আমার কথা হল, সব সইতে হবে কেন? মা বলে, ‘যে সয় সে রয়’। এই রয়ে যাওয়াটা আমার কাছে নিতান্ত পরাজয় মনে হলেও মায়ের দৃষ্টিতে অনন্য বিজয়। মা এলে মাঝে মাঝে আমি ফুলের সুগন্ধ পাই। আমার আলস্যগুলো আমার কিশোরীবেলার মত চাগার হয়ে ওঠে মা এলে। মা এলে আমার সাতাশ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বাপের আদর পাই, আবেশ পাই। মা এলে আমার মরু নেমে আসা বেলকনির গাছেরা প্রাণ ফিরে পায়। তারা হাসে,রোজ ফুল ফোটায়। তারাও আমার মত মায়ের আদর পেয়ে আহ্লাদে বেঁচে ওঠে। মা যেন আশ্চর্য এক মোহহীন ভোর। অনন্ত, অফুরন্ত নির্মলতা, অব্যক্ত শান্তির সুধা ছড়িয়ে দেয়া এক প্রত্যক্ষ প্রকৃতি আমার মা। শহরের কায়দা–কানুনে রপ্ত হওয়া এই আমি,পথ চলার ছোট ছোট নানান টোটকা আজো আশ্চর্য হয়ে শিখি মায়ের কাছ থেকে। এই সমস্ত সমাধান কেবল মায়েদের কাছেই থাকে। অন্য কেউই এই ছোট ছোট মুক্তির পথ এ পৃথিবীতে দেখাতে পারে না। আমার মা, আমার শক্তি, আমার সাধনা,আমার নির্বাণ!
আজ মা ফিরেছে নিজের বাড়ি। আর তারপর থেকেই যেন আমি নিঃস্ব, আমি অবশ,বিবশ। যেন সূর্য ডুবেছে মাত্র। এই নিরবতায় মোড়ানো সায়াহ্ন আমার চোখে জোয়ার আনে,হৃদয়কে অভিমানে বড্ড ভার করে রাখে। আমি এরুমে, ওরুমে, ঠাকুরঘরে, বেলকনিতে, রান্নাঘরে মাকে খুঁজে বেড়াই। মায়ের বদলে যাওয়া শাড়িতে মুখ ডুবিয়ে রাখি,মায়ের গন্ধ খুঁজে ফিরি। ঘুম ভাঙলেই ওমা, ওমা ডেকে আবার স্তব্ধ হই। মায়ের ছায়া,মায়ের মায়া রোমন্থন করেই কেটে যায় আমার সময়ের অনন্ত প্রবাহ।