আমার মাতৃভূমি হোক অসাম্প্রদায়িক চেতনার

ড. উজ্জ্বল কুমার দেব | বৃহস্পতিবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২১ at ২:২৭ অপরাহ্ণ

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যখন বাঙালি জাতিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ডাক দিয়েছিলেন, তখন তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনের প্রেক্ষাপটেই তা করেছিলেন। আমরা জানি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র -এ চারটিই সংবিধানের মূল স্তম্ভ। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করে। এছাড়া এটি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করে, যা কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণকে সমর্থন করে না। উপরন্তু সব ধর্মের মানুষকে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালনের অধিকার নিশ্চিত করে। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শুধু যে বাংলাদেশের সংবিধানেই আছে তা কিন্তু না; কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে ও আমরা সেটা দেখতে পাই। কিন্তু লক্ষণীয় যে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন কালে আমাদের এ দেশটিতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিনিয়ত হুমকির মুখোমুখি। কিন্তু এই ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা বাস্তবে কেন আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে দেখতে পাচ্ছি না, কেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিবেশের বিকাশ ঘটছে না, তা পর্যালোচনা করা আজকের বাস্তবতায় অত্যন্ত জরুরি। একথা মানতে হবে যে, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার্থে ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই। তবে আমাদের সংবিধান ও বিদ্যমান আইনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও এটির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগে তা বিঘ্নিত হতে দেখি নানা কারণে। যেমন-সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার ধর্মনিরপেক্ষতার পথে অন্তরায়। আরো দেখা যায়, সাম্প্রদায়িক আচরণ ও মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিক অধিকারকে প্রতিনিয়ত ক্ষুন্ন করে। আমরা যখন দেখি সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং সাম্প্রদায়িক হামলা গুলোর বিচারহীনতা চলে তখন তা হামলাকারীদের আরও হামলা করতে উৎসাহ যোগায়। এক্ষেত্রে প্রকৃত অপরাধী ও তাদের ইন্ধনদাতাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা অসম্ভবই থেকে যাবে।
সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করলাম কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুমিল্লাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন : নোয়াখালী, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও রংপুরে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দুদের মন্দির ও বসতবাড়ি আক্রমণের শিকার হয়। এতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। কুমিল্লার ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়া, বটতলা ও হাতিবান্ধা গ্রামে অন্তত ২০টি বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। আরও জানা যায় হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং সংঘর্ষের ঘটনায় ১০৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আক্রমণের মূলহোতারা ও ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে শুনলাম। গ্রেপ্তার হয়, আইনের আওতায় আনা হলেও শাস্তি হয় এরকম নজির দেখা যায়নি। এধরনের অপরাধের শাস্তি না হওয়া বিচারহীনতার পাশাপাশি অপরাধীদের চক্রান্ত করার মনোবল দৃঢ় করে। ভবিষ্যতেও একই রকম পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে পুনরায় হামলা ও বিশৃঙ্খলা করবে এবং বেড়ে যাবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। এ ধরনের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা জন্ম দিবে পুনরায় সলখ্যালঘুদের ওপর কোন এক সাম্প্রদায়িক হামলার। আর একারণেই দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন হচ্ছে। আমার বিশ্বাস সরকারের কঠোর মনোভাব এবং দোষীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর করা হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হবে না।
ঘটনা পরম্পরায় এটা এখন পরিস্কার যে, কুমিল্লার ধর্ম অবমাননার বিষয়টি একটি কুচক্রী সাম্প্রদায়িক মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে ঘটিয়ে ও গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে। ঘটনায় জড়িত ইকবাল হোসেন ও সহযোগীদের ইতিমধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কৃতজ্ঞতা সেই তিনজন ছাত্রকে যাঁরা ইকবালের মতো অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করেছে। এরকম একটি প্রজন্ম আমরা প্রত্যাশা করি আমাদের দেশে। এখন সাধারণ মানুষ দেখে আছে পুলিশ ও প্রশাসন কি করে তাদের নিয়ে। কারণ এবার জোরালোভাবে আলোচনায় উঠে আসে প্রশাসনের ভূমিকার কথা। অনেক জায়গায় প্রশাসন ও পুলিশ নির্বিকার থাকার প্রত্যক্ষ প্রমাণও পাওয়া গেছে। যেমনঃ হামলা হতে পারে এমন খবর পাওয়ার পর হাজীগঞ্জের রামকৃষ্ণ সেবা আশ্রমের পক্ষ থেকে পুলিশ প্রশাসনকে বিষয়টি নাকি জানানো হয়েছিল। আশ্রমের পক্ষ হতে প্রশাসনের সহযোগিতাও চাওয়া হয়। বিষয়টি দেখবেন বলেও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন আশ্বাস দিলেও কোন উদ্যোগ নেয়নি। আশ্রম ও থানার দূরত্ব খুব বেশি না হলেও এক ঘণ্টা ধরে আশ্রমে নির্বিচারে হামলা, ভাঙচুর ও অত্যাচার চালানো হলেও প্রশাসনের কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ জায়গায় পরিস্কার একটা প্রশ্ন থেকে যায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে।
সাম্প্রতিকতম বিভিন্ন মন্দির ও মণ্ডপে হামলাগুলো দেখে বোঝা যায় এটি পূর্ব পরিকল্পিত। সাম্প্রদায়িক শক্তি যে একতাবদ্ধ এটা তারই ইঙ্গিত বহন করে। তারা পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ হলেও সোজাকথা যারা এ ধরনের হামলা ও নির্যাতন নিপীড়ন চালায়, তারা অসহিষ্ণু। এ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মনে করে পৃথিবীতে একটিই ধর্ম থাকবে, অন্য কোন ধর্ম থাকবে না। এই অসহিষ্ণুতার কারণেই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। আগেই বলেছি জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর যে নির্দেশে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো এবং তিনি বাংলাদেশের জন্য যে সংবিধান রচনা করেছেন সেখানে অন্য ধর্মের সহিষ্ণুতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, বাস্তবে তা খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।। অতএব আমরা যদি এর আশু সমাধান চায় আমাদের মূলে হাত দিতে হবে। ধর্ম, মত ও পথ ভুলে এক্ষেত্রে সকল অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বিদ্যমান সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্ম পালনের অবাধ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। বর্তমান সরকার ও প্রশাসন উপর জনগণ আস্থা রাখতে চায়। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর মনোভাব এবং অবস্থান নিলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সঙ্ক্ষু বিচার হবে। অপরাধীর দৃষ্টান্তস্বরূপ কঠোরতম শাস্তি হলে এমন ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি হবে না। আশাকরি ভবিষ্যতে এসব ঘটনা এড়ানো যাবে এবং গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো অঙ্কুরেই বিনাশ করা হবে। সমাজ থেকে দূর করতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প। অন্ধকার দূর করতে হলে আমাদের মনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলো জ্বালতে হবে, তবেই রক্ষা হবে সম্প্রীতি।
লেখক : প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে চলছে ২য় ডোজ গণটিকাদান
পরবর্তী নিবন্ধচবির ‘বি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অনুপস্থিত ১৩ হাজার