আজ একটি কবিতা লেখা হবে, আজ একটি গান লেখা হবে বলেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ছাত্র–জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অবশেষে লেখা হলো কবিতা ও গান।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। সাথে বিশ্ববাসীর জন্যও। দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে পালিত হয়। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়। গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন–একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের স্মরণিকায় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ কিশোর অহিউল্লাহ, রিকশাচালক আবদুল আউয়ালের নাম উল্লেখ আছে। শেষোক্ত দুইজনের এখনো মেলেনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি।
বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালির আত্ম–অম্বেষায় যে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর–ডিসেম্বরে ভাষা–বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের মার্চে এ নিয়ে সীমিত পর্যায়ে আন্দোলন হয় এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। চট্টগ্রামে বসে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখলেন – ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি। ‘একুশের প্রথম কবিতাটি মুদ্রণের জন্য কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের তৎকালীন ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী ও প্রেস কর্মচারীদের সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি ও আগ্রহের ঐকান্তিকতা রীতিমতো স্মরণযোগ্য।…১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি (মতান্তরে ২৩ ফেব্রুয়ারি) লালদীঘির ময়দানে বিশাল জনসভায় কবিতাটি পাঠের পর এর লেখক মাহবুব উল আলম চৌধুরী, পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদ এবং কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি মুদ্রণের জন্যে প্রকাশক কামালউদ্দিন আহমদ বিএ–এর নামে হুলিয়া জারি হয়। জনসভায় কবিতাটির প্রথম পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কবিতাটির পাণ্ডুলিপি দেখাতে অসমর্থ হলে মুদ্রাকর দবির আহমদ চৌধুরীকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এ জন্যে তাঁকে ছয়মাস জেলও খাটতে হয়েছিল।’(‘প্রসঙ্গ : একুশের প্রথম কবিতা’, চৌধুরী জহুরুল হক, কোহিনূর প্রকাশন, ২০০২, পৃষ্ঠা : ২৬–২৭)।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ ঐতিহাসিক এই গানের রচয়িতা আব্দুল গাফফ্ার চৌধুরী। কালজয়ী গান হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও এটি প্রথমে গান হিসেবে লেখা হয়নি। লেখা হয়েছিল কবিতা হিসেবে। গেণ্ডারিয়ার ধুপখোলা মাঠে যুবলীগের একটি অনুষ্ঠানে সর্বপ্রথম এই কবিতাটি আবৃত্তি করা হয়। পরবর্তীতে কবিতাটির সুরারোপ করেন আব্দুল লতিফ। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা কলেজের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে তৎকালীন ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে আব্দুল লতিফের সুরে সর্বপ্রথম গানটি গাওয়া হয়। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একুশের প্রভাতফেরির গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
গানটি একটি খবরের কাগজের শেষের পাতায় একুশের গান শিরোনামে প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন গীতিকারের নাম ছাপা হয়নি। পরে অবশ্য গীতিকারের নাম ছাপা হয়। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত হয় গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশ ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালায়, এতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ ছাত্র হতাহত হয়। সেই সময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী ঢাকা মেডিকেলে যান আহত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেলের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল রফিকের লাশ। তৎক্ষণাৎ তার মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠে। পরে কয়েক দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লিখেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে এটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সংকলনে’ও এটি প্রকাশিত হয়।
ঢাকা কলেজের কিছু ছাত্র কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার স্থাপনের চেষ্টা করার সময়ও গানটি গেয়েছিল। গানটি গাওয়া ও লেখার দায়ে ঢাকা কলেজ থেকে ১১ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান লাভ করেছে। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কালজয়ী প্রভাতফেরির গানটি বাঙালি যতদিন থাকবে চির জাগরুক থাকবে। আর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’–অমর কবিতাখানি বাঙালির চেতনাকে জাগ্রত করে আজও।