বাবা হিসেবে স্মৃতি হাতড়িয়ে শিশুকাল থেকে যার শাসন,মায়া–মমতা আর দিক নির্দেশনায় বড় হয়েছি তিনিই ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া। বাবা ২৮ এপ্রিল ২০২৪ আমাদের শোকের মহাসাগরে নিমজ্জিত করে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অনন্তধামে গমন করেন।ঠিক এক বছর সময়ের মধ্যে বাবাকে অনেকবার মানসপটে ভেসে উঠতে দেখেছি। ভেসে উঠে নানা কথা, নানা ঘটনা, নানা স্মৃতি। হরেক রকমের অনুভূতির ক্যানভাসে বাবাকে অবচেতন মনে ডাক দেই,স্পর্শ করতে চাই,প্রণাম করতে চাই। কিন্তু বাবা যে সে ডাক শোনা ও প্রণাম করার জায়গা থেকে অসীম পানে চলে গেছেন।
আমার বাবা ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া। নানা বিভূষণে বিভূষিত ও নানা অলংকরণে অলংকৃত করতে দেখেছি উনাকে সমাজের পক্ষ থেকে। প্রথমত সুবক্তা হিসেবে উনার অবস্থান অনেক সমৃদ্ধ ছিল। তাঁর সমমানের বক্তা সমাজে খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। তাঁর বক্তৃতা যারা শুনেছেন তারা তন্ময় হয়ে যেতেন। সভা–সমিতিতে যখন বিশৃঙ্খলা, জগাখিচুরি অবস্থা তখন বাবা বক্তৃতা শুরু করলে পিনপতন নীরবতা চলে আসতো। দ্বিতীয়ত সমাজসেবক হিসেবেও বাবার অবস্থান ছিল শীর্ষবিন্দুতে। সমাজসেবার কথা বলতে গেলে বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি সংঘ প্রচার সংঘ‘র কথা এসে যায়।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ বাংলাদেশী বৌদ্ধদের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এক সংগঠন। বাবা সুদীর্ঘ ৪৩ বছর যাবৎ প্রচার সংঘের মহাসচিব হিসেবে সমাজে আলোকদীপ্ত অবস্থান রচনা করেছেন। শুধু বাংলাদেশ কেন বিশ্বের কোথাও জাতীয় ভিত্তিক সংগঠনে সুদীর্ঘ ৪৩ বছর মহাসচিব, সাধারণ সম্পাদক বা জেনারেল সেক্রেটারির পদে অবস্থান করা খুব সম্ভবত কারো পক্ষে সম্ভব হয় নি। সেই নিরিখে সাংগঠনিক দক্ষতার বিচারে এ অনবদ্য এক বিশ্ব রেকর্ডও বলা যেতে পারে। অনন্য সাংগঠনিক প্রতিভার দীপ্তি ছড়িয়ে নানা সংকট, দুর্যোগে বাবার ব্জ্রকণ্ঠ বারবার গর্জে উঠেছে। প্রচার সংঘের প্রতিনিধি হয়ে বাবা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ইংল্যান্ড, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনামসহ বিশ্বের ২৮টি দেশ সফর করেছেন। তৃতীয়ত লেখক হিসেবেও বাবা বেশ সফল ছিলেন।লেখালেখিতে বাবা বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন পত্রিকায় বাবার লেখা গুরুত্ব সহকারে ছাপানো হতো। নানা ম্যাগাজিন, পত্রিকায় বাবার সহগ্রাধিক লেখা ছাপানো হয়েছে।এমনকি বাংলা একাডেমি থেকেও বাবার একাধিক বই বের হয়েছে। বাবার জীবনের শেষদিন গুলোতে ৯০ বছর বয়সেও বাসায় গেলে বাবাকে দেখতাম লেখালেখিতে মগ্ন থাকতে।
বাবা পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব না হলেও রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ৫২‘র ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে বাবার বিপ্লবী ভূমিকা প্রত্যক্ষ করা যায়। ৫২‘র ২২ ফেব্রুয়ারী চট্টগ্রাম কলেজের প্রগতিশীল ছাত্রদের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা হয়। ঐ মিছিলের স্লোগান ধরেন বাবা। একাত্তরের ৭ই মার্চ অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য বাবা রাঙুনিয়া কলেজের অধ্যাপনা থেকে অব্যাহতি দেন। এপ্রিলের শেষে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ভারতের নানা রাজ্যে প্রচারাভিযান চালান। তাছাড়া কোলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন ও আকাশবাণীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি বিবৃতি দেন।
সমাজে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি দেশ–বিদেশে অনেক উপাধি, সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। তন্মধ্যে একুশে পদক, মাহাত্মা গান্ধী এ্যাওয়ার্ড, মাদার তেরেসা গোল্ড পীস এ্যাওয়ার্ড, অল সিলোন বুড্ডিস্ট কংগ্রেস, শ্রীলঙ্কা কর্তৃক সম্মাননা, ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, বৌদ্ধ রত্ন, ভারতের ইন্টারন্যাশনাল ব্রাদারহুড মিশনের স্বর্ণপদক, ডঋই সাউথ কোরিয়া রিজিওনাল সেন্টার কর্তৃক সম্মাননা ও ২০১৬ সালে আবুরখীলবাসীর পক্ষ থেকে আজীবন সম্মাননা উল্লেখ্য।
বাবাকে আমরা দেখেছি নির্লোভ, নিরহংকার, উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। পেশাগত জীবনের শুরুতে বাবা ৩টি সরকারি চাকুরি পাওয়া সত্ত্বেও যোগদান করেন নি।এমনকি ১৯৬৩ সালে সাব ডিভিশনাল এডুকেশন অফিসার এর লোভনীয় চাকুরীকেও তিনি অবহেলা করেছেন। তিনি ভাবতেন সরকারি চাকুরি করলে তো দেশের নানা স্থানে বদলী করতে পারে। বদলি করলে তো প্রচার সংঘ করা যাবে না, সমাজসেবা করা যাবে না।
বাবা সমাজের উন্নয়নের কথা বাদ দিয়ে যদি নিজের, পরিবারের উন্নয়নের কথা ভাবতেন তবে নিশ্চয় উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যেতেন। আত্নত্যাগের কারণে বৈষয়িক দিক দিয়ে বাবার অবস্থান সমৃদ্ধ তো নয় বরং বেশ সাধারণ মানের। কিন্তু বিশাল আত্মত্যাগ, নির্লোভী মনোভাব ও অনবদ্য অবদানের জন্য বাবা তথা ড. প্রণব কুমার বড়ুয়া জনতার হৃদয়ের মণিকোঠায় বেশ সমৃদ্ধশালী ও উচ্ছসিত প্রশংসনীয় অবস্থানে নিশ্চয় অবস্থান করবেন সব সময়। বিগত নানা শাসনামলে অনেকে পদ, পদবীর অপব্যবহার করে অবৈধ কালো টাকার মালিক হলেও বাবা তথা প্রণব বড়ুয়া ছিলেন শতভাগ সৎ। নির্ভেজাল সমাজনীতি, শুদ্ধতা আর সততার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন তিনি। তাইতো প্রত্যেক দলের কাছে, প্রত্যেক সংগঠনের কাছে, প্রত্যেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কাছে, প্রত্যেক সমাজসেবকের কাছে বাবাকে আদর্শ, মডেল বলা নিশ্চয় অত্যুক্তি হবে না বরং তা হবে বাস্তবতারই নামান্তর। সংগত বাস্তবতায় বাবার মৃত্যুর পর বাবার যে ১টি ট্রাংক ছিলো সেখানে খুঁজে পাওয়া গেল মাত্র ৩ টাকা। বাবা যে চির বিদায় নিবেন সেটা নিশ্চয় আগে থেকে জানতেন। কারণ তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁকে মৃত্যুর পর কোথায় দাহ করা হবে ও স্মরণসভার ধরণ কেমন হবে সব তাঁর অনুজ আমার সেজ কাকা প্রসুন বড়ুয়াকে বলে গেছেন। মহাপ্রয়াণের দিন সকালেও বাবা পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেছেন। বড়পুত্র সাবেক খ্যাতনামা ফুটবলার ও বিশিষ্ট সাংবাদিক দেবাশীষ বড়ুয়া দেবুর মুখ নিঃসৃত বুদ্ধ বাণী শোনার পর পরই সকাল ১০:৫০ টায় পরপারে গমন করেন। কাজেই তাঁর মৃত্যু বেশ পুণ্যময় ছিল। এমনকি এক মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে পেয়ে আমরা বেশ গর্বিত। আজ বাবা নেই, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন। কিন্তু বাবার আদর্শ আমাদের সমৃদ্ধ জীবন ও সুনির্মল সমাজ, দেশ বিনির্মাণে পাথেয় হয়ে উঠুক এ প্রত্যাশা করছি। পরিশেষে সমাজসেবা জগতে অনন্য অবদানের জন্য বাবা তথা ড. প্রণব কুমার বড়ুয়াকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক প্রদানের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে, সমাজের পক্ষ থেকে সদাশয় সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : ডঃ প্রণব কুমার বড়ুয়ার কনিষ্ঠ পুত্র।