দেখতে দেখতে প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেলো বাবাকে ছাড়া। ২০১৩ সালের এমন দিনে বাবার প্রিয় পত্রিকা ‘আজাদী’ অফিসে গিয়ে মৃত্যুর ঘণ্টাদুয়েক আগে ‘বিরস রচনা’ শেষবারের মতো জমা দিয়ে এসেছিলেন। এ যেন নিজেই নিজের বিদায়ের বাণী শুনিয়ে এসেছেন। বাবার মৃত্যুর দিন আমি এবি ব্যাংক নজুমিয়াহাট শাখায় কর্মরত। ওই বছরই আমি চকরিয়া শাখা থেকে বদলি হয়ে নজুমিয়াহাট শাখায় এসেছিলাম। বাবা বলেছিলেন, একদিন আমি নজুমিয়াহাট শাখায় যাবো। ওখানে আমারও অনেক বন্ধু রয়েছে। তোমার সাথে পরিচয় করে দিবো। কিন্তু বাবার আর এবি ব্যাংক নজুমিয়াহাট শাখায় যাওয়া হলো না।
১২ বছর পেরিয়ে গেলো! প্রতিদিন বাবার অনুপস্থিতি নতুন করে অনুভব করি। শুক্রবার আসলেই মনে পড়ে আজ ‘বিরস রচনা’ পড়ার দিন। অনেক সময় বাবার লেখা বাবাকে পড়ে শোনাতাম। তথাপি বাবার অনেক ছাত্র–গুণগ্রাহী ‘বিরস রচনা’ সম্পর্কে ফোনে তাঁকে মন্তব্য করতেন। লেখা পড়ে পাঠকের মন্তব্য সরাসরি লেখকের কানে পৌঁছালে সে লেখা অবশ্য জীবন্ত ও সরস লেখা বলে বিবেচিত হয়। বাবাও তখন তাঁর লেখার সার্থকতা খুঁজে পেতেন। তিনি দীর্ঘ ২২ বছর দৈনিক আজাদীতে সাধুভাষায় লিখে এসেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সমকালীন লেখকদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত দীর্ঘ সময় সাধু ভাষায় লেখালেখি করেছিলেন।
মহাকালের মহাসাগরে বারো বছর তলিয়ে গেলো কোন ফাঁকে টেরই পেলাম না। এই বারো বছরের কোনো শুক্রবারই ‘আজাদী’ ছাড়া যায়নি। হকার আমার বাসায় আজও আজাদী পত্রিকা দিয়ে যায়। কিন্তু বাবার ‘বিরস রচনা’ থাকে না। বাবা নেই, কিন্তু তাঁর ছায়া আছে, ভাষা আছে, চিন্তা আছে। বাবার বই–কলম আর রেখে যাওয়া মূল্যবোধ সবই যেন আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। বাবার কলম ছিলো দীপ্ত, চিন্তা ছিলো দূরদর্শী এবং প্রতিবাদী। সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ নিয়ে সবসময় প্রতিবাদী ছিলেন। তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখতেন শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, ঘুষমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা।
দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত বাবার হাজারো কলাম পাঠকের হৃদয়ে আলো জ্বালায় আজও। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা শুধু পেশা নয়, এটা জাতি গঠনের দায়িত্ব। সেই বিশ্বাস থেকে তিনি গড়েছেন প্রতিষ্ঠান, সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস।
স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে বাবা প্রথম কর্মজীবন শুরু করেন ঢাকা আবুজর গিফারী কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসাবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি নিজ গ্রাম আনোয়ারায় কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি গ্রামে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সত্যিই কঠিন চ্যালেঞ্জের ছিলো। তিনি আনোয়ারা অঞ্চলের অনেক গ্রামে গ্রামে গিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য চাল–টিনসহ নগদ অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
তিনি ১৯৭২–১৯৮১ সাল পর্যন্ত আনোয়ারা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রামের বাইরে আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নেন তিনি। ফেনী জেলার ছাগলনাইয়া কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। তখন কলেজটি ছিলো টিন শেডের। তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর এ কলেজ তিন তলা দালানে রূপ নেয়। একই সঙ্গে চালু হয় বিজ্ঞান বিভাগ ও ডিগ্রি কোর্স। ১৯৮৯ সালে কলেজটি সরকারিকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আমার বাবা। এছাড়া ছাগালনাইয়ায় গণপাঠাগার, উদয়ন কিন্ডার গার্টেন নামের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁর অনন্য ভূমিকা রয়েছে।
গত ক’দিন আগে আমার ছোটমেয়ে জুমানাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ফেনীর ছাগলনাইয়ায়। এখানে এসে আমার মেয়ে তার দাদার ছাত্র ও গ্রণগ্রাহীদের মুখে শুনতে থাকে দাদার অনেক গল্প ও স্মৃতিকথা। দাদার ব্যাপারে এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনে জুমানা সত্যিই অবাক হয়! চট্টগ্রাম থেকে ভিন্ন একটি অঞ্চলের মানুষ এতো বছর পরও তার দাদাভাইকে এভাবে মনে রেখেছে! সত্যিই অবাক করার মতো ব্যাপার। আমি আমার মেয়েকে বললাম, এসব তোমার দাদাভাই তাঁর কর্মের মধ্যদিয়ে সৃষ্টি করে গেছেন, যার জন্য তিনি ব্যয় করেছেন অনেক মেধা ও শ্রম।
ছাগলনাইয়া সরকারি কলেজের নবনির্মিত ভবন দেখে খুবই ভালো লাগলো আমার। কিন্তু এ কলেজের এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল দেখে মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায়। ৫৭৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪১৪ জনই ফেল করেছে! স্বাধীনতার পর ছাগলনাইয়া কলেজে এতো খারাপ ফলাফল আর হয়নি। বাবা বেঁচে থাকলে এ খবরটি শুনে মন খারাপ করতেন নিশ্চয়।
১৯৮৯ সনের পর বাবা যোগদান করেন ওমরগণি এমইএস কলেজে। এ কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে অল্পদিনের মধ্যে তিনি প্রশাসনিক অনেক কিছু পরিবর্তন আনেন। যা অবশ্য অধ্যাপক নোমান আহমেদ সিদ্দিকী স্যারের লেখাতে বিস্তারিত রয়েছে। বাবা বাংলা সাহিত্যের মানুষ হলেও ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস ও রাজনীতি প্রভৃতি নিয়ে তাঁর আগ্রহের কমতি ছিলো না। শুধু তাই নয়, এসব বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যও বিস্ময়ের। মাঝেমধ্যে আমার বন্ধু ডা. সালাউদ্দিন সাহেদ (বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও লিভার বিশেষজ্ঞ) বাসায় আসলে তার কাছে স্বাস্থ্য বিষয়ক অনেক খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করতেন। বিশেষ করে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, লিভার রোগে বিশেষায়িত সেবা, রোগ নির্ণয়ের আধুনিকায়ন, সরকারি হাসপাতালের সেবার মান বৃদ্ধি ও ঔষধের কার্যকারিতা প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ আলোচনায় থাকতো প্রান্তিক মানুষের সহজ চিকিৎসাসেবা পাওয়া। আনন্দের বিষয় হলো, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সম্প্রতি (গত ৭ অক্টোবর ২০২৫) হেপাটোলজির ইনডোর সেবা চালু হয়। ডা. সাহেদের সাথে হেপাটোলজির ইনডোর সেবা নিয়ে কত কথাই না তিনি বলেছিলেন। অথচ এ সেবা আজ সত্যিই চালু হলো, কিন্তু তিনি দেখে যেতে পারলেন না।
৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শহীদদের নামে বাংলাদেশের একমাত্র কলেজ বাকলিয়া শহীদ এন.এম.এম.জে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়েও বাবার বন্ধু সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল নোমান কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য গুরুদায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁকে। তিনি উক্ত কলেজ প্রতিষ্ঠাকালীন সাংগঠনিক সদস্য সচিব ছিলেন। কলেজের নামকরণও করেছিলেন বাবা। এ কলেজের জমি অধিগ্রহণের সময় তাঁর নামে অনেক মামলাও হয়।
বাকলিয়া শহীদ এন.এম.এম.জে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম মতবিনিময় সভার চিঠি আমি নিজে বিভিন্ন ব্যক্তির বাসায় গিয়ে পৌঁছে দেই। বাবার অবদানের জন্য বাকলিয়া কলেজে তাঁর নামে ‘অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান স্মৃতি পাঠাগার’ রয়েছে। এখনো প্রতি বছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এর জন্য আমি কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও সকল কর্মকর্তাকে আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। কয়েকদিন আগে প্রফেসর শায়েস্তা খান স্যারের জানাজায় দেখা হয়েছিলো প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমানের যোগ্যসন্তান সাঈদ আল নোমানের সাথে। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরেন আর বাকলিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠার স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন।
আসলে বাবার কর্মযজ্ঞের কথা কিংবা স্মৃতি এই সামান্য আলাপে–সংলাপে–লেখায় শেষ হবার নয়। এই অন্তঃপ্রাণ মানুষটি শুয়ে আছেন চকবাজার কাপাসগোলা জামে মসজিদের কবরস্থানে। প্রতি শুক্রবার কবর জেয়ারতের জন্য যাই। যেখানে আমার বাবার পাশে শুয়ে আছেন আমার মা, দাদা, দাদী, মেজো চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান গণি খান ও সেজো চাচা রফিকুল হোসেন খান।
পরিশেষে বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মাননীয় মেয়র ডাঃ শাহাদাত হোসেনকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বর্তমানে কাপাসগোলা কবরস্থানে ২৫টি লাইট পোস্ট ও কবরস্থানের ভেতরে রাস্তা করে দেয়ার জন্য।
লেখক : অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খানের জ্যেষ্ঠপুত্র ও ব্যাংক কর্মকর্তা ।











