আমার বাংলাদেশ

মিলন কান্তি দে | রবিবার , ১২ মার্চ, ২০২৩ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের লীলাভূমি এই বাংলার ওপর বারবার লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী চক্রের। এ ভূখন্ডের মাটি ও মানুষকে তারা শোষণ করেছে, করেছে অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু মুক্তিপাগল বাংলার সংগ্রামী জনতা হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছে, তবু দেশের এক কণা মাটিও বিদেশি স্বৈরশাসককে উপহার দেয়নি। বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁওয়ের অধিপতি হন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ওই সময় দিল্লির সম্রাট ফিরোজ শাহ তোঘলকের সিপাশালার তাতার খাঁ অতর্কিতে বাংলা আক্রমণ করলে ইলিয়াস শাহ স্বাধীনতা রক্ষার উদাত্ত আহবান জানালেন দেশপ্রেমিক জনতাকে– ‘আমার জান কবুল। সোনারগাঁও, সাতগাঁও, ঢাকাএ তিন অঞ্চল জুড়ে আমি গড়ে তুলব এক দেশ, যার নাম হবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে দেশের মানুষ একই ভাষায় কথা বলবে, একই সুরে গান গাইবে, একই কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে জয়ধ্বনি দেবেস্বাধীন বাংলার জয় (‘গঙ্গা থেকে বুড়িগঙ্গা’ যাত্রাপালার একটি সংলাপ)।’

ইতিহাসের পালা বদলের পরিক্রমায় স্বাধীনতার জন্য শহিদ হন নবাব সিরাজ, তিতুমির, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন সহ আরও কত বীর বিপ্লবী। পলাশী প্রান্তরে বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের হীন চক্রান্তে যে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ১৯৭১ এ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই সূর্যকে আবার ছিনিয়ে এনেছে বাংলার দামাল ছেলেরা।

৫২ এর ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধঅবিরাম সংগ্রাম আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বিশ্বের মানচিত্রে আমরা পেয়েছি এক সার্বভৌম অখন্ড স্বাধীন দেশ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, কর্ণফুলী বিধৌত আমার প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে বাংলাদেশের বয়স এখন ৫২। তবুও মনে হয়, এইতো সেদিন ওই সবুজময় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে গোটা দেশ কেপে উঠেছিলএবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। মনে হয় এইতো সেদিন আমরা অস্ত্র হাতে লড়াই করেছি, বাঙালি বিচ্ছুদের হাতে খালে বিলে মরেছে পাকিস্তানি খানসেনারা, এইতো সেদিন ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা পৌঁছে গেছে বাংলার আমজনতার কাছে, ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের বেশে বাঙালি ফিরেছে তার স্বদেশ তীর্থভূমিতে, এইতো মনে হয় সেদিন মাথায় রাজমুকুট পরে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি আমাদের মুজিব ভাই রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, কবিগুরু দেখে যাও বাংলার মানুষ স্বাধীনতা এনেছে। আজ তোমার বাণী মিথ্যে হয়ে গেলসাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধা জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি।

৭১এর মার্চে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সব শ্রেণি পেশার মানুষের পাশাপাশি আমরা যাত্রাশিল্পীরাও হাটে মাঠে ঘাটে মিছিল করেছি। দেশের গান গেয়েছিবঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গান, ‘ধন্য বাংলা হে বিজয়ী বীর ধরিয়া তোমায় বক্ষে/কত যে সাজাল কুসুমঅর্ঘ্য তোমার চরণ লক্ষ্যে।’ ব্যানারে ফেস্টুনে কবি নজরুলের উদ্ধৃত দিয়ে লিখেছিলাম, ‘এ দেশ ছাড়বি কিনা বল/নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। আর অর্থনৈতিক মুক্তির দৃপ্তপদভারে এগিয়ে চলেচেন মানবতার জননী শেখ হাসিনা। সর্বগ্রাসী করোনা কালেও মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে দোরগোড়ায় পৌঁচে দিয়েছেন গোটা জাতিকে। দেশদ্রোহী, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি সন্ত্রাস সমূলে উচ্ছেদ করা নিরন্তর লড়াই তাঁর অব্যাহত। এখন দলমত নির্বিশেষে আমাদের অঙ্গিকার করতে হবে সেই লড়াইয়ে এক কাতারে সামিল হওয়া। আমরা চাই অপশক্তি ও অপসংস্কৃতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুন্দর বাংলাদেশ। কারণ আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য স্বরন করিয়ে দেয়, এই সেই দেশ যেখানে মুসলমানের মসজিদের পাশে দাড়িয়ে আছে হিন্দুর দেব মন্দির, এই সেই দেশ যেখানে হিন্দুর সন্ধারতির শঙ্খঘন্টার সঙ্গে মুসলমানের আজান ধ্বনি, আকাশে বাতাসে ভেসে ওঠে, এই সেই দেশ যেখানে মুসলমানের জন্য হিন্দু প্রাণ দেয়, হিন্দুর জন্য মুসলমান জীবন আহুতি দেয়এই দেশটি আমার বড় প্রিয়, বড় সাধনার ধন। যুদ্ধে জাগরণে শৌর্যে বীর্যে সাম্য সম্প্রীতিতে যে দেশটি গোটা বিশ্বের বিস্ময় আমার বাংলাদেশ।

লেখক : বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যকার ও যাত্রা গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য
পরবর্তী নিবন্ধচোরাই গরু ব্যবসার দ্বন্দ্বে সংঘর্ষ, নিহত ১