আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | মঙ্গলবার , ৭ জুন, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

লেখক, প্রবন্ধকার, কলামিস্ট, সাংবাদিক, সমাজ সচেতন, দেশপ্রেমিক, গীতিকার, কবি আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত “পরীমণি তুমি কেঁদো না” কবিতাটি পড়ে যেমন বিস্মিত হয়েছি, তেমনি মুগ্ধ হয়েছি। বাণীসমৃদ্ধ কবিতাটি যেন জলপ্রপাতের ঝংকার, যেন উত্তাল সাগরের ঊর্মিমুখর জোয়ার, যেন নীল আকাশে সোনালি চাঁদ। কবিতাটি নিয়ে সমালোচনা আলোচনা হয়েছে। হবেই তো। সাহিত্যিকদের অনেক লেখা কাউকে বিস্মিত করে, কাউকে মুগ্ধ করে, কাউকে হিংসায় জর্জরিত করে তোলে। আজকাল সবাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু এক সময় এক শ্রেণীর শিক্ষিত লোক (নিরক্ষর লোক তো আর কবিতা পড়েন না) বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে কাফের সম্বোধন করতে দ্বিধা করতো না। এমনকি বিদ্রোহী কবিতাকে কটাক্ষ করে ব্যঙ্গ কবিতাও লেখা হয়েছিল। দুখি একজন মানুষ। নামটাও দুখু মিঞা। সারা জীবন যতদিন সুস্থ ছিলেন দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জারিত হয়েছেন। পুত্রশোকে কাতর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে হাসির কবিতা লিখেছেন কখনো বা রোমান্টিক গান লিখেছেন। সমাজের সব শ্রেণির মানুষের প্রতি কবি নজরুলের অসীম মায়া মমতা। সোচ্চার কন্ঠে সাম্যবাদের কথা বলেছেন। কুলি, মজুর, বারাঙ্গনা শ্রমিক, সবাইকে কবি নজরুল কবিতার মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। তাঁর “নারী” কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে চিরকালের অবহেলিত নারীর বঞ্চনা, যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি। কবি দুঃখের সাথে লিখেছেন, “কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে/ কত নারী দিল সিঁিথর সিঁদূর, লেখা নাই তার পাশে”।

অনেক কবি সাহিত্যিক তাঁদের লেখায় নারীর অন্তরের বেদনা মানসিক নির্যাতনের ছবি লিপিবদ্ধ করে নারীর প্রশস্তি বাণী প্রকাশ করেছেন। কবি গাফ্‌ফার চৌধুরীও লিখেছেন “তোমার চোখের কান্নায় দেখেছি আমার মায়ের চোখের জল”। নারী দিবসে নারীদের জন্য কত মায়া মমতার প্রকাশ দেখতে পাই। কিন্তু একজন বিতর্কিত নারীকে কি মায়ের সাথে তুলনা কেউ করতে পারে? অথবা সেরকম সাহস ক’জনার আছে। মোনালিসার ছবিটি যদি সম্ভ্রান্ত নারীর ছবি না হয়ে সাধারণ নিম্নশ্রেণির নারীর ছবি হতো তবে কি মোনালিসার হাসি দর্শকের হৃদয়কে আলোড়িত করতে পারতো! লিওনার্দো দ্যা ডিঞ্চি কি সমালোচনার হাত থেকে রক্ষা পেতেন? কবি গাফ্‌ফার চৌধুরী যদি কোন রাজকন্যা বা মহিয়সী নারীকে নিয়ে এরকম অসামান্য কবিতা লিখতেন তবে সবাই আনন্দিত হতো। গর্ববোধ করতো। কিন্তু তিনি কেন সাধারণ একজন নারীকে অসীম মূল্য দিলেন? কারণ মহৎ ব্যক্তিরা পাপকে ঘৃণা করেন, পাপীকে নয়। সমাজে যাঁরা অসাধারণ যাঁদের হৃদয় সাগরের মত বিশাল তাঁরা সব শ্রেণির মানুষের প্রতি মমতা অনুভব করেন। তাঁরা উপলব্ধি করেন পাপের পংকিল পথে যারা নারীকে ধাবিত করে, তারা প্রকৃত পাপী। যারা নির্যাতিত, যারা অবহেলিত যারা প্রবঞ্চনার শিকার হয়ে পংকিল পথে হাঁটে তাদের অন্তরে দুঃখ সঞ্চিত থাকে। তাদের চোখে থাকে অশ্রুজল কিন্তু মুখে থাকে স্নিগ্ধ হাসি। নইলে ভুবনভুলানো রূপ নিয়েও কেন মেরিলিন মনেরোকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে চিরদিনের মত ঘুমিয়ে পড়তে হলো। তবে এ যুগের মেরিলিন মনেরোরা আত্নহত্যা করে না। তারা জোয়ান অব আর্কের মত সাহসী। নির্যাতিত অনেকে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু সুফল পায় কি পুরুষশাসিত সমাজে বাস করে? অনেক রহস্য চিরকাল গোপন থাকে সে জটিল অংকের শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘জোয়ান অব আর্ক’ সমাজকে উজ্জীবিত করেছিলেন। তবু তো তাঁকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো।

কে পাপী কেন পাপী কে পাপের পথে নিরীহ অবুঝ অসহায় নারীকে ঠেলে দেয় তা সবাই জানে, তবু সমাজের যূপকাষ্ঠে অনেক নারী বলি হয়। রাজা রামমোহন রায় যখন ইংরেজ শাসকের সহায়তায় বিধবা নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা আইনের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছিলেন। তখন তিনিও কি সমালোচিত হন নি। সমাজের শিরোমণি ব্যক্তিরা হৃদয়ে উল্লাস নিয়ে নারীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখতে না পেরে বড়ই দুঃখিত হয়ে হয়তো রাজা রামমোহন কে মনে মনে অভিসম্পাত দিয়েছিলেন। রামমোহন রাজা ছিলেন, ধনী সম্ভ্রান্ত ছিলেন তাই তাঁর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতা সমাজের ছিল না। কিন্তু যদি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতো তবে হয়তো তাকেও আগুনে পুড়িয়ে মেরে সমাজপতিরা শান্তিতে ঘুমাতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা নারীর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন (শাস্ত্রের নিয়ম বের করে) তবু সমাজের শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিদের কি প্রচন্ড রাগ। বিধবারা কেন বিয়ে করবে। বিপত্নীক দু’তিনটা বিয়ে করলে অসুবিধা নেই (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে আছে) অথচ দু:খি বিধবা নারীদের ন্যাড়ামুন্ডু করে, একবেলা উপোস রেখে সমাজের উচ্চশ্রেণির শিরোমনি ব্যক্তিরা এক ধরনের পৈশাচিক উল্লাস অনুভব করতেন। কি অদ্ভুত মানুষ পৃথিবীতে বাস করে। আশ্চর্য লাগে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর উপন্যাসে রাজলক্ষী, চন্দ্রমুখীদের কথা লিখেছেন। নারী পুরুষ অনেকের সে সব গ্রন্থ পড়ে চোখ অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। এখনও কত অসহায় নারী পরিবারের কারণে, সমাজের সহযোগিতায়, স্বামী অথবা আত্মীয় স্বজনের নিপীড়নে পাপের পংকিল জলে অবগাহন করে। কখনো বা নিবোর্ধের মত পংকিল আবর্তে দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাজলক্ষী, চন্দ্রমুখীদের সিমেমায় দেখে সবাই তাদের জন্য দুঃখে জল ফেলে। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখতে পেলে তাদের কাহিনী জানতে পারলে বেশির ভাগ মানুষের অন্তর ঘৃণায় তিক্ত হয়ে ওঠে। অথচ দেবদাসের প্রতি কি মমতা। দেবদাস মদ খেলেও, পংকিল পথে হাঁটলেও তার প্রতি কারও মন বিমুখ হয় না। তার কোন বদনাম নেই। বরং সবাই ভাবে আহা দেবদাস তো দুঃখি মানুষ, পার্বতীর জন্য তার হৃদয় ভারাক্রান্ত। সে তো মদ খাবেই। সে তো বাঈজির কাছে যাবেই। কিন্তু পার্বতী যদি মদ খেতো, পংকিল পথে হাঁটতো তবে কি সে দেবদাসের মত পাঠকের হৃদয়ে মমতা লাভ করতে পারতো! বরং পার্বতীর চরিত্রে কলংক লেপন করা হতো, তাই তো পাবর্তীকে বৃদ্ধকে বিয়ে করে সুখি হবার ভান করতে হয়।

যুগের পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু সমাজ নির্মল হয় নি। বরং বিষবাষ্প বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতৃপ্তি, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, লোভলালসা সমাজকে কলংকিত করে তুলছে। অঢেল টাকা পয়সা, অতুলনীয় সুনাম, রাজকীয় থাকা-খাওয়া তবু কিছুতেই এ যুগের অনেক মানুষ শান্তি পাচ্ছে না। নিজেও নষ্ট হচ্ছে। অনেককে কলংকিত করছে। সমাজকেও পংকিল করে তুলছে।

শান্তিপ্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষ লগনে এসে দু’টো বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবী ব্যাপী দুঃখ-যন্ত্রণা, প্রতারণা, হিংসা, হত্যার তীব্রতায় অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন। তবুও তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারান নি। বরং বলেছেন “অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে/ শান্তির অক্ষয় অধিকার”। জনাব গাফফার চৌধুরী একুশের গানের রচয়িতা! চিরদিন মানবতার জয় গান করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও দেখেছেন সমাজ কলুষমুক্ত হতে পারে নি। দেশমাতৃকার চোখ থেকে বেদনায় জল ঝরছে। ব্যথিত, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি মানুষের মঙ্গল কামনা করেছেন। তাই তো লিখেছেন, “ভালবাসা বড় দুর্লভ সৌরভ/ সুগন্ধির দোকানে কখনো পাবে না।”

লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅমর একুশের এক নির্ভীক কলমযোদ্ধা
পরবর্তী নিবন্ধরক্ত দিতে হাটহাজারী থেকে চমেকে প্রতিবন্ধী মেহরাজ