আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | বৃহস্পতিবার , ২৪ জুলাই, ২০২৫ at ৫:০১ পূর্বাহ্ণ

জীবনে অনেক কিছু দেখার আছে, শেখারও আছে; তবে সীমারেখা মেনে চলা উচিত

সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের ঢালে চাবাগান, কোথাও সবুজ শ্যামলিমা, কখনো গাছের পাতায় সূর্যের সোনালি রঙের ছটা। বিকেলের নরম আলো, নীল আকাশ, চারপাশে সবুজ অরণ্য। কোথাও গাছ এত দীর্ঘ মনে হয় যেন আকাশকে স্পর্শ করবে। কোনো জায়গায় নির্জন অরণ্যের মাঝে নিকষ কালো পাথরের ফাঁক দিয়ে নির্ঝরের জলতরঙ্গের কুলকুল ধ্বনির মূর্ছনা। কোথাও হরিৎসবুজ উপত্যকার বুক চিরে প্রবাহিত হয় আকাবাঁকা অজানা পথে প্রবহমান মৃদু ঢেউয়ে দোলায়িত নদী। পান্না সবুজের মাঝে যেন হীরের ঝলকানি। কোথাও বিশাল পাহাড়ের মাঝে সংকীর্ণ শ্যাওলা পিছন পথ। কখনো সাগরের অতল জলরাশির উর্মিমুখর হাতছানি।

এ সবই দূরে কোথাও নয়। এ দৃশ্যগুলো আজ আমাদের বাংলাদেশের অনেক স্থানে দৃশ্যমান। মায়াবী প্রকৃতি আমাদের আহবান করে। তাই আমরা ঘর ছেড়ে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ি। বাংলাদেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র, সমতলে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি। পৃথিবীতে কত কি দেখার আছে! সব কি দেখা সম্ভব? কেউ কি সব দেখতে পেরেছে? তবু তো আমাদের উৎসাহী মন প্রকৃতির অন্তহীন সৌন্দর্য দেখার ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে ছটফট করে।

কক্সবাজারের সমুদ্রের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় চিরপিয়াসী। অনেক আগে তরুণ বয়সে যখন প্রথম কক্সবাজারে গিয়েছিলাম তখন সমুদ্রতীরে পর্যটক বেশি ছিল না। হোটেল রেস্তোরাঁ সংখ্যায় নগন্য ছিল। জনসমুদ্র, কোলাহল ছিল না। তাই কক্সবাজার শহরে পৌঁছাতেই শোনা যেতো সাগরের শোঁ শোঁ আওয়াজ। গাড়ি থেকে নামলে পাওয়া যেতো স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ। কক্সবাজারে তখন (১৯৭৩) মনে হয় পর্যটনের মোটেল বা রেস্ট হাউস ছিল না। সায়মন হোটেলের সুনাম ছিল। পরে পর্যটন মোটেল তৈরি করবে সেজন্য মোটেলের নাম দেবার জন্য (মনে হয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছিল) আহবান করা হয়। লাবনী, সৈকত, তটিনী, সাগরিকা ইত্যাদি নাম পাঠিয়েছিলাম। আরো অনেকে অংশগ্রহণ করেছিলেন। পুরস্কার স্বরূপ কিছু অর্থ মানি অর্ডারে (পর্যটনের সীল ছিল) পাঠানো হয়েছিল। অর্থের চেয়ে মোটেলের নাম দিতে পেরেছিলাম। সেজন্য খুব আনন্দিত হয়েছিলাম।

সে সময় পর্যটক যেহেতু কম ছিল তাই একটু দূরে নির্জনে সমুদ্রস্লান করতে অসুবিধা হতো না। শাড়ি পরে সমুদ্রে নামলে খুব অসুবিধা হয়। শাড়ি পায়ে জড়িয়ে যায়। ঢেউয়ের দোলায় সাগরে পড়ে যাবার ভয় থাকে। একদিন সাগরের জলের সামান্য ভেতরে দাঁড়িয়েছিলাম। ঢেউ এসে তীরে আছড়ে পড়ছিল। খুব ভালোলাগছিল। পায়ের নিচে বালুতে সাদা ফেনার অপূর্ভ শোভা। দেখতে না দেখতেই হঠাৎ একটা বিশাল ঢেউ এসে এমনভাবে ধাক্কা দিয়েছিল যেন গভীর সাগরে আমাকে নিয়ে যাবে। আরেক দিন সাগরের পানিতে মনের সুখে ডুব দিচ্ছি হঠাৎ মনে হলো পায়ের নিচে বালি সরে যাচ্ছে এবং ঢেউয়ের ধাক্কায় আমি তলিয়ে যাচ্ছি। মুজিব পাশে ছিল। তাকে সজোরে ধরে ছিলাম। সে যাত্রায় আল্লাহর রহমতে রক্ষা পেয়েছিলাম।

এসব স্মৃতিকথা আমি এ কারণে লিখছি আজকাল অনেক কিশোর তরুণ আনন্দ করতে এসে করুণভাবে সাগরে হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ সাঁতার জানলেও একটার পর একটা ঢেউ এমনভাবে আসে তখন সামাল দেয়া যায় না। তাই সাগরে নামতে গেলে খুবই সতর্ক হতে হবে। কক্সবাজার সমুদ্রে একবার বিদেশিদের দেখেছিলাম। তারা সাগরের ঢেউকে কৌশলে সামলে সাঁতার দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। উন্নত দেশের ছেলেমেয়েরা শৈশব থকে থেকে সুইমিং পুল ও সাগরে গোসল করে অভ্যস্ত। তারা সমুদ্র খুব ভালবাসে। গ্রীষ্মকালে ঘন্টার পর ঘন্টা সাগরের তীরে এক ধরনের ক্রীম মেখে রৌদ্রস্লান করে। সাদা চামড়াকে বাদামী করতে ভালবাসে। যদিও কালো ও বাদামী চামড়ার প্রতি আজও অনেকের বিতৃষ্ণা রয়েছে। মানুষ সভ্য হয়েছে মুখে অবজ্ঞা প্রকাশ করে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে অধিকারশ মানুষ আজও বর্ণ, ধর্ম ও অর্থের বিভেদকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

নেপালের প্রসিদ্ধ ঋবধি খধশব একেবারে চট্টগ্রামের ফয়ে’স লেকের মতো। সেখানে নৌকাগুলো ছিল ডিঙি নৌকার মত। নৌকায় ইঞ্জিন নেই। নির্দিষ্ট কিছু ছেলে বা মেয়ে বৈঠা দিয়ে নৌকা চালায়। লেকের দু’পাশের দৃশ্য খুবই মনোরম তবে ভয় হয় নৌকা উল্টে যাবে না তো? নৌকায় চড়ার আগে আমাদের সবাইকে লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়েছিল। লাইফ জ্যাকেটের জন্য সামান্য অর্থ দিতে হয়। জীবনের নিরাপত্তার জন্য তা কিছুই না। একবার পদ্মা ব্রীজ দেখতে গিয়েছিলাম। তখন আমরা বোটে (ইঞ্জিন আছে) পদ্মা নদীতে ভ্রমণ করেছিলাম। আমাদের লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়েছিল। কারণ পদ্মা বিশাল নদী। মাঝ নদীতে বিপুল ঢেউ। সেজন্য নদী, লেক সাগরে সর্বত্রই নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ভ্রমণ করা খুবই জরুরি। আমাদের দেশে লঞ্চ, স্টীমার, স্পীড বোট ইত্যাদিতে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা থাকলে দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে যাবে।

মেক্সিকোতে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে ঈধহপঁহ বীচের পাশে হোটেলে কয়েকদিন ছিলাম। বারান্দা বসে দেখতাম রাত ৮/৯ টা পর্যন্ত পর্যটকরা সমুদ্রে স্লান করছে। বাচ্চারা পর্যন্ত নির্ভয়ে সাগরের পানিতে অনবরত ডুব দিয়ে আনন্দ করছে। অথচ কক্সবাজারের সাগরে দুর্ঘটনা ঘটে। আমার মনে হয় ককাসবাজারের সাগরের নিচে হয়তো চোরাবালি রয়েছে। অথবা জোয়ার ভাঁটার কারণে সাগর অনেক সময় বিপদ জনক। এজন্য সমুদ্রতীরে সতর্ক বাণী লেখা দরকার। সম্প্রতি তিনজন শিক্ষার্থী সাগরের পানিতে ডুবে গিয়েছিল। দু’জনের মরদেহ পেলেও একজনের দেহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তরুণ শিক্ষার্থীর মা বলেছিলেন, ছেলেকে সাগরে রেখে আমি ঢাকায় ফিরে যেতে পারবো না। কি করুণ কথাগুলো, মায়ের আর্তনাদ আমাদের অন্তরে আঘাত করে। সন্তানের অকাল মৃত্যু মাবাবার সংসারকে বিপর্যস্ত করে দেয়। বিখ্যাত গজল গায়ক জগজিৎ সিং এবং চিত্রা সিংএর লাভ ম্যারেজ ছিল। সুখি দম্পতি। হঠাৎ তাদের বিশ বছরের সন্তান গাড়ি এ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছিল। এরপর জগজিৎ সিং ও চিত্রা সিংএর সুখি জীবনে ফাটল ধরেছিল। অবশেষে ডিভোর্স হয়ে যায়। অন্তরের তীব্র বিষাদ, দুঃখ মৌনতা দু’জন সুখি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। এরকম ঘটনা অনেকেরই জীবনে দেখা গিয়েছে। মানসিক ডাক্তারও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। সন্তান হারানোর ব্যথা জীবনের সুখ নষ্ট করে দেয়।

পাহাড়ের গিরিখাতে ঘুরতে গিয়ে আজকাল অনেক পর্যটক হারিয়ে যাচেছ। গিরিখাতের ভেতরে রয়েছে সংক্রীর্ণ রাস্তা। কোথাও পানির স্রোত। অথবা পাহাড়ের সুড়ংগ। অনেক জায়গায় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। ঝরণা দেখতে অনেকে পাহাড়ের অরণ্যের ভেতরে চলে যায়। রোমাঞ্চ, উত্তেজনার আবেগে ভরপুর তরুণ পর্যটকের সময়ের জ্ঞান থাকে না। তখন রাতের অন্ধকারে অনেকে নিবিড় অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলে। ফলে ফিরে আসতে সক্ষম হয় না।

আমাদের প্রতিবেশির রাষ্ট্র নেপাল, ভারত ও ভুটানে রয়েছে, বরফ শুভ্র পর্বত, গভীর অরণ্য, অপরূপ বিশাল ঝরনা। কিন্তু সেখানে ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত সুব্যবস্থা রয়েছে। কারণ সেখানে বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য সব রকম আয়োজন যত্নের সাথে করা হয়। আমাদের দেশে পর্যটকরা অবহেলিত। দর্শনীয় স্থানের বিভিন্ন জায়গায় আধুনিক ও পরিকল্পিত ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া তরুণরা অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়া দুঃসাহসের সাথে পাহাড়ি অঞ্চলে ভ্রমণে বের হয়। এর জন্য প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। মাবাবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া ও ভ্রমণে সুবিধাঅসুবিধা বিবেচনা করে দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করার খুবই প্রয়োজন। নইলে বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।

জীবনে অনেক কিছু দেখার আছে। তাই সীমারেখা মেনে সবার চলা উচিত। যুগ পাল্টেছে। কিন্তু জীবন তো সহজ হয় নি। বরং বাংলাদেশের জীবন এখন জটিলতায় ভরা। দ্রুত মোটর সাইকেল চালিয়ে আজকাল অনেকে সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নিজেকে এবং অন্যকে বিপদে ফেলতে দ্বিধা করছে না। এসব প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হচ্ছে না। তাই সন্তানকে নিরাপদ রাখতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে সচেতন হতে হবে।

টীকা : সুখদুঃখে ভরা জীবন অনেক সুন্দর। মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য নিজের এবং অপরের জীবনকে সুন্দর করে তুলতে সহায়তা করা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইকবাল হায়দার ও তাঁর সঙ্গীতের সমাজতত্ত্ব মরমীবাদ
পরবর্তী নিবন্ধউপমহাদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম