আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | রবিবার , ১৫ জুন, ২০২৫ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

ঈদ উৎসবের অন্তর্নিহিত অর্থ হলো মানুষের জন্য নিবেদিত হওয়ার প্রেরণা

মুসলমানদের জীবনে উৎসবের সংখ্যা খুবই কম। ‘ঈদ’ উৎসব পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি মুসলমানদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ফল্গুধারা। ‘ঈদ’ শব্দের ব্যবহারিক অর্থ খুশির দিন অথবা আনন্দের দিন। প্রতি বছর দু’টি ঈদ আসে অফুরন্ত আনন্দের জোয়ার নিয়ে। একটি রজমান মাসে রোজার শেষে ঈদউলফিতর। অন্যটি জ্বিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ ঈদউলআযহা।

ঈদ ধর্মীয় উৎসব। ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম, মৈত্রীর ধর্ম, সাম্যের ধর্ম। প্রকৃতপক্ষে যুগ যুগ ধরে প্রতিটি ধর্মেই মানুষের কল্যাণের জন্য উপদেশমূলক বার্তা এবং বিধি বিধান পালন করার নিয়ম রয়েছে। মানুষের অন্তরে বিরাজ করে পাপ এবং পুন্য। মানুষ পাপের পথে যাতে ধাবিত না হয় সেজন্য ধর্মের মাধ্যমে মানবাত্ত্বাকে পুণ্যের প্রতি কল্যাণের প্রতি আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইসলাম ধর্মেও দু’টো ঈদ শুধুমাত্র আনন্দ উৎসবের জন্য প্রচলিত হয় নি। এর অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থ হলো মানুষের জন্য নিবেদিত হওয়ার প্রেরণা। রমজান মাসে নির্দিষ্ট বয়সের পর প্রতিটি সুস্থ নারীপুরুষের জন্য রোজা রাখা ফরজ অর্থাৎ অবশ্য কর্তব্য। সুস্থ মানুষ রোজা না রাখা গুনাহর কাজ। উপবাস রাখার মাধ্যমে মুসলমানরা ক্ষুধার্ত দুস্থ দরিদ্র মানুষের উপবাস ক্লিষ্ট কষ্ট উপলব্ধি করতে পারে। সারাদিন উপবাসে ক্লান্ত মানুষ সহজেই ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা বুঝতে পেরে অসহায় মানুষের প্রতি মমতাবোধ করে। তখন মুসলমান শুধু নিজে ইফতারের খাবার গ্রহণ করবে না সে সাথে দারিদ্রপীড়িত মানুষকেও আন্তরিকতার সাথে খাবার বিতরণ করতে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। ঈদ উদযাপন করার প্রাথমিক প্রস্তুতি দীর্ঘদিন উপবাসের মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণ কামনা করা এটাই মহান আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা। ঈদউল ফিতর শুধু উপবাসের মধ্য দিয়ে দুখি মানুষের জন্য অন্তরে মমতাবোধ সৃষ্টি করা নয়। সে সাথে ফিতরা বা জাকাতের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য করার ব্যবস্থাও রমজানের ঈদের অপর একটি মহৎ উদ্দেশ্য। অনেক রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের ধ্যান ধারণা বজায় রয়েছে। কিন্তু শত শত বছর পূর্বেই ইসলাম ধর্মে প্রচলিত রয়েছে জাকাতের কঠিন বিধান। জাকাত তাৎপর্য পূর্ণ সুপরিকল্পিত বিধান। তাই প্রত্যেক সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিকে তার সম্পদের থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দান করা অবশ্য কর্তব্য। জাকাতের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে সমাজের সবাইকে স্বচ্ছল করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যেক ধর্মেই অর্থ দান করা পুণ্যের কাজ। কিন্তু ইসলাম ধর্মে দরিদ্র ও দুস্থ মানুষের জন্য জাকাতের অর্থ দান করা ধনীদের জন্য সুশৃংখল কর্তব্য। রমজানের সময় তাই বেশির ভাগ ধনী ও স্বচ্ছল ব্যক্তি দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আর্থিক সাহায্য করে থাকেন। প্রতিটি সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তি নিম্নবিত্ত আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীকে জাকাতের অর্থ প্রদান করে সমাজে সুখ ও শান্তি স্থাপন করতে সহায়তা করতে পারেন। অনেক বছর আগে বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কোটিপতি ছিলেন। এখন সমাজে ব্যবসায়ী ও উচ্চপদে অধিষ্ঠিত প্রায় সবাই কোটিপতি। তাঁরা যদি ঠিকমত জাকাত দেন তবে সমাজে অনেক দরিদ্র মানুষ অন্তত দু’বেলা পেট পুরে খেতে পারবেন এবং তাদের সন্তানকে লেখাপড়া করাতে পারবেন। এবার বি সি এস পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদের অনেকে দরিদ্র পিতা মাতার সন্তান। তারা অনেকে বলেছে তাদের মাবাবা শ্রমিক অথবা মেহনতি মানুষ। তাই তারা শৈশব কৈশোর থেকে লেখাপড়ার সাথে সাথে পরিবারে অর্থ উপার্জনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করতো। অনেকে বেতনের অভাবে ঠিকমত স্কুলে যেতে পারে নি। অনেকে ইউনিফর্ম তৈরি করতে না পারার কারণে অনেক সময় স্কুলে উপস্থিত হতে পারে নি।

বাংলাদেশের স্বচ্ছল মানুষরা যদি তাদের নিজের গ্রামের শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষার্থী ও শিক্ষাকেন্দ্রকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন অন্তত পক্ষে জাকাতের অর্থ দান করেন অনেক মানুষ উপকৃত হবেন। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর আর্থিক অনটন দূর হবে। জাকাত অবশ্যই দিতে হবে। নইলে গুনাহর ভাগীদার হতে হবে। এ কথা মনে রেখে ধনী ও স্বচ্ছল ব্যক্তিদের জাকাত দিতে হবে। তাদের জাকাতের অর্থ সমাজের অভাব দৈন্য অনেকখানি নির্মূল করতে সহায়তা করবে। সমাজের ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই ঈদউলফিতর মহানন্দে উদযাপন করতে পারবে।

ঈদউলআযহা আমাদের কাছে কুরবানির ঈদ হিসেবে পরিচিত। কুরবানির ঈদের তাৎপর্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাণী বহন করে। তাই শুধুমাত্র পশু কুরবানি দিলেই পুণ্য অর্জন সম্ভব না। পশু কুরবানির মাধ্যমে মুসলমানকে তার অহং ত্যাগ করে মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হয়। কিন্তু এ বার্তা ক’জন মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। কুরবানির ঈদে গরুর হাটে যেন লাখ লাখ টাকা প্রদর্শনের আয়োজন। আজকাল উটও যুক্ত হয়েছে। লক্ষাধিক টাকার গরু ও উটকে বিচিত্রভাবে সজ্জিত করা হয়। যারা টাকা প্রদর্শনের জন্য লক্ষাধিক টাকার গরু ও উট কেনেন তারা কি কুরবানির ঈদের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন? মহান আল্লাহ তাআলা কত মেহেরবান। তিনি প্রিয় নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে পুত্র সন্তানকে কুরবানি না দিয়ে পশু উৎসর্গ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি যদি আমাদের মর্মে পৌঁছে থাকে তবে আমাদের ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শকে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। সীমিত টাকায় গরু বা ছাগল ক্রয় করা যায়, লাখ লাখ টাকা বাহ্‌বা পাওয়ার জন্য গরু বা উট ক্রয় না করে অধিক অর্থ থাকলে তা হাসপাতাল অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করতে পারেন। এতে পুণ্য সঞ্চয় হবে এবং সম্মান লাভ করা যাবে। অহংকারী মানুষকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন না। এ কথা পবিত্র কোরআনে অনেকবার বলা হয়েছে। আল্লাহ পছন্দ করেন নির্মল প্রাণের সরল মানুষকে। মানুষের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কিছু করার মাধ্যমে পরম করুণাময়ের নৈকট্য লাভ করা সম্ভব হয়। এ কথা মনে রেখে মুসলমানগণ তাৎপর্যপূর্ণ দু’টো ঈদ যেন সার্থকভাবে উদ্‌যাপন করতে পারেন এবং শান্তি, সাম্য ও মৈত্রীর বাণী সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন।

টীকা : কুরবানির ঈদের মাংস স্বল্প মাত্রায় সংরক্ষণ করে অধিক মাত্রায় দান করার মধ্যেই রয়েছে কুরবানির ঈদের আনন্দ ও সার্থকতা। আপনি কি তা মনে রেখেছেন?

লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজচট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসীতাকুণ্ডে পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু