নারী দিবসে নারীদের সমস্যাবহুল জীবনের অনেক অকথিত কথা বলার আছে। নারীদের জীবনে অনেক সমস্যা কেবল নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করার কারণে। বিবরণ শুনলে মনে হবে এ আর নতুন কী? এসব তো সেই পুরানো কাহিনি। শৈশব, কৈশোর থেকে নারীদের ওপর দৈহিক ও মানসিক অত্যাচারের কাহিনি শুনে এ দেশের সবাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তাই হয়তো সমাধানের জন্য তেমন উদ্যোগ নেই। সমগ্র পৃথিবীতে নারীরা যুগে যুগে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছে। ৮ মার্চ নারীদের অধিকার আদায়ের সফলতার প্রতীক। তবে সমাজে এখনো লিঙ্গ বৈষম্য, স্বল্প মজুরী, প্রভৃতি সমস্যা নির্মূল করা সম্ভব হয় নি।
প্রাচীনকাল থেকে নারীরা সব সময় বৈষম্যের শিকার হয়েছে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। তাই তো পৌরানিক যুগের কাহিনী সমৃদ্ধ ‘মহাভারতে’ পঞ্চপাণ্ডবের উপস্থিতিতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ঘটনা পাঠকের মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। তবে নারীকে তুচ্ছ করা যায় না। দ্রৌপদীর অবমাননার কারণে দুর্যোধনদের ধ্বংস হয়েছিল। সুন্দরী হেলেনের কারণে ট্রয় নগর ধ্বংস হয়েছিল। নারীর অন্তরের সৌন্দর্য ও মাধুর্যের সাথে রয়েছে নারীর অন্তর্নিহিত ‘শক্তি’। সে শক্তি কখনো আগুনের লেলিহান শিখার মতো ধ্বংস করে দিতে পারে রাজ্য, নগর এমনকি ক্ষুদ্র সুখের সংসারও। তাই বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সব সময় নারীকে মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছেন। ফলে তাঁরাও লাভ করেছেন সমাজ ও মানুষের প্রশংসা ও ভালোবাসা। মহাভারতের কাহিনিতে শ্রীকৃষ্ণ দ্রেীপদীকে রক্ষা করেন। কিন্তু এ যুগে তো শ্রীকৃষ্ণ নেই। তাই অসহায় নারীরা নিভৃতে কাঁদে। লোক সমাজে মুখ লুকিয়ে রাখে। বিচার হয় না। বিচারের নামে প্রায় সময় প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবে এক সময় শিশুকন্যাকে জীবন্ত কবর দেয়া হতো। চিন্তা করলে গা শিউরে ওঠে। হযরত মুহাম্মদ (দ🙂 ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন ও নারীদের মর্যাদানের জন্য অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কিন্তু ধর্মের সুন্দর নিয়মাবলী মেনে চলে ক’জন? নারীকে মানুষ হিসেবে দেখা, তার প্রতি ন্যায় বিচার করা উচিৎ এটা তো ইসলাম ধর্মের বিধান। ইসলামে কি যৌতুক প্রথা রয়েছে? বরং স্ত্রীকে সম্মান দেবার কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের ধর্ম মানুষের কল্যাণের কথা বলে। কিন্তু মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে নারীর ওপর দৈহিক ও মানসিক অত্যাচার করে। সতীদাহ প্রথার মাধ্যমে নারীদের জীবন্ত পোড়ানো হতো। বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ করে নারীকে গৃহের অন্তরালে কষ্ট দেয়া হতো। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ দয়ালু মহান ব্যক্তিদের সহযোগিতা না পাওয়া গেলে নারীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ করতে আরও অনেক বছর লেগে যেতো। মুসলমান সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের মতামতের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু অভিভাবকরা সমাজের ভয়ে কি নারীদের সে সুযোগ দেন? এগারো বারো বছরের কিশোরীকে বিয়ে দিয়ে মা বাবা নিজেদেরকে নিরাপদে রাখেন। সন্তানকে অনিয়শ্চতার গর্ভে ঢেলে দিয়ে অভিভাবকরা আত্নপ্রসাদ লাভ করেন। আধুনিক যুগে বেগম রোকেয়া পথ না দেখালে মুসলমান নারীরা কি লেখাপড়া করে আত্নবিকাশের সুযোগ লাভ করতেন ?
ভারতবর্ষে অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নারীরা কিন্তু সব সময়ই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ খুঁজতেন। মুঘল নারীরা কবিতা লিখতেন, ছবি আঁকতেন এবং সাম্রাজ্য পরিচালনায় সম্রাটকে সাহায্য করতেন। রাজিয়া সুলতানা, ঝাঁসির রানি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনা করে রাজ্য রক্ষার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। শিক্ষালাভের জন্য একসময় এদেশের নারীরা স্বত:স্ফূর্ত আনন্দের সাথে শিক্ষানিকেতনে ভর্তি হতে লাগলেন। ফলে বাংলাদেশের নারীদের এগিয়ে চলা শুরু হয়। তাই তো আজ সমাজে নারীরা শিক্ষাসংস্কৃতি, শিল্প কারখানায়, অফিস আদালতে, কৃষি খামারের বিস্তৃত পরিসরে পরিশ্রম করে স্বাধীন স্বপ্নের ভুবন গড়ে তুলতে সমর্থ হচ্ছে।
নারী দিবস উপলক্ষে অনেক আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। সভা–সমিতিতে নারীর উন্নতির জন্য বেহিসাবি ডিনারের সাথে ( চায়ের কাপে ঝড় না কারণ সেটা মধ্যবিত্তদের অধিকারে) বিত্তবান শিক্ষিত নারী পুরুষরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকরী হয় না। কারণ বড় বড় কথা বলা সহজ। প্রকৃতপক্ষে যা প্রয়োজন তা হলো শিক্ষিত– নিরক্ষর সবধরনের নারীপুরুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন দরকার। আমাদের দেশে বর্তমানে দেখা যায় সমাজে নৈতিকতা, শিষ্টতা, ভদ্রতা, ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষককে গলা ধাক্কা দেন তবে কী আশা করা যায় সেসব শিক্ষার্থী কোন দিন লেখাপড়া সম্পন্ন করে ভালো মানুষ হবে? মানুষকে মর্যাদা দিতে সমর্থ হবে? তাহলে ভবিষ্যতে তাদের কাছ থেকে নারীরা কীভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করবে। কেউ যদি অন্যায় করে তবে তার জন্য আইন আছে। সভ্য দেশে কেউ তো আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। বিদ্যালয়ের কোমলমতি ছাত্রীরাও যে রকমভাবে শিক্ষকদের পদত্যাগ করিয়েছে তা দেখে বিবেকবান মানুষ বাধ্য হয়ে ভেবেছে এরা কাদের সন্তান? এদের মা বাবা কেমন? সন্তানের কারণে মা বাবার মাথা যেমন উঁচু হয় তেমনি সন্তানের কারণে মা বাবার মাথা হেঁট হয়। তাই তো কথায় আছে কাউকে সম্মান করলে নিজেও সম্মানিত হতে পারা যায়।
মায়ের তুলনা নেই। প্রায় সংসারে সন্তানরা মাকে খুব ভালোবাসে। তাই একজন মা পারেন সন্তানকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে। মা হলেন সন্তানের প্রথম শিক্ষক। তাই মায়ের সৎ চরিত্রের সততা, শিষ্টতা, নিলোর্ভতা সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। নারী হিসেবে একজন মাকে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে। কন্যা সন্তানকে পুত্র সন্তানের মত ও নারীকে পুরুষের মত সম্মান প্রদান করতে হবে। যৌতুকের লোভ প্রায় ক্ষেত্রে শাশুড়ির অন্তরে বিরাজ করে। অনেক শাশুড়ি বৌমাকে ঘরে এনে তার সাথে ঘরের গৃহকর্মীর মত আচরণ করে। বউমা হবে ফর্সা, পুতুলের মত সুন্দর ইত্যাদি নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যকে প্রাধান্য দেয় সমাজের অনেক নারী। ফলে নারীদের বিউটি পার্লারের আশ্রয় নিতে হয়। এ সমস্ত কারণে নারীর অসম্মান ও অমর্যাদা হয়, তা এদেশের অনেক নারীরা তা উপলব্ধিও করতে পারে না।
বর্তমান সময়ে নারীদের সমস্যা নিয়ে এখনও অনেক ভাবনা চিন্তা করার দরকার। সর্বপ্রথমে নারী ও পুরুষ দু’জনের দৃষ্টিভংগী ও মানসিকতা বদলাতে হবে। শুধু শিক্ষিত হলে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হতে হলে মানবিক এবং সৎ চরিত্রের গুণাবলীর প্রয়োজন। অনেক আগে নারীরা স্কুল–কলেজে যেতেন না। কিন্তু তাদের সন্তান বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক মধুসূদন দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখদের লেখায় মায়ের প্রতি ও নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও মায়ামমতা বিকশিত হয়েছে। তাঁরা তাঁদের পরিবারের নারীদের দেখে নারীকে মর্যাদা দানের কথা চিন্তা করেছেন।
বাংলাদেশে এখনও কন্যা সন্তানকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে নারীরা আজও অবহেলিত হচ্ছেন। পথে–ঘাটে ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের সাথে অনেক সময় অশোভন আচরণ করা হয়। এ ধরনের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে আজও নারীদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
আমাদের দেশে নারীদের পথ চলায় প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নারীরা সব বাধা তুচ্ছ করে চড়াই–উৎরাই পার হয়ে ঠিকই এগিয়ে চলেছেন। হিমালয়ের শীর্ষে আরোহন, ফুটবল ক্রিকেট খেলায় শিরোপা অর্জন, উচ্চ শিক্ষাগ্রহণ করে দেশে বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল, কর্মক্ষেত্রে, পোশাক শিল্পে, কৃষি খামারের কাজ করে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন সবই আজ নারীদের উন্নতির লক্ষণ। নারীরা যদি প্রকৃত শিক্ষাগ্রহণের সাথে সাথে সৎ মানবিক চরিত্র গঠনে উদ্যোগী হন তবে আমরা সমাজে অনেক সুস্থ উদার মনের মানুষ দেখতে পাবো। পুরুষ ও নারী সমাজের একই বৃন্তে দু’টি ফুল। তাই নারী দিবসে প্রত্যাশা রইলো বসন্তের পলাশ ও শিমূলের মত সমাজে নারী ও পুরুষ দু’জনে যেন মানব মনে আনন্দ ছড়িয়ে দেন এবং সুন্দর সমাজ ও সুখি বাংলাদেশ গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট।