বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। দেশকে আমরা প্রায় সবাই ভালোবাসি। মা, মাতৃভাষা আর মাতৃভূমি আমাদের সবার প্রিয়। এ দেশের সন্তানরা তাই দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রাণ দিতে দ্বিধা করেন না। অনেক বছর আগে এ দেশের বেশির ভাগ জনগণ দেশপ্রেম সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। না হলে বন্দী জবাব সিরাজদ্দৌলাকে নিয়ে সে দেশের মানুষ ব্যঙ্গবিদু্রপ করতো না। ইংরেজরা যে বিদেশি শত্রু এ উপলব্ধি তারা করে নি। বিদেশি মোগলা ভারতবর্ষ জয় করে অনেক বছর বংশ পরম্পরায় নির্বিঘ্নে রাজত্ব করেছিল। ভারতবর্ষের কিছু কিছু রাজ্যের শাসকরা বিদ্রোহ করেছিলেন। কিন্তু মোগলদের তরবারির সম্মুখে তাঁরা বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হন। ইংরেজরা ভারতবর্ষ অধিকার করার পর তাদের শোষণ ও অত্যাচারে ভারতবর্ষের জনগণ ধীরে ধীরে সচেতন হতে থাকে। প্রথম আন্দোলন শুরু হয় সিপাহীদের আন্দোলনের মাধ্যমে। মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে শূকর হারাম আর হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে গরু পবিত্র। গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে গুলি তৈরি হয়েছিল।
সে গুলির খোসা মুখ দিয়ে খুলতে হতো। এ কারণে হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যরা ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সে আন্দোলনকে ইংরেজরা “সিপাহী বিদ্রোহী” নামে অভিহিত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের মানুষের সেটাই প্রথম স্বাধিকার আন্দোলন। তবে সে আন্দোলন সফল হয় নি। কারণ সে আন্দোলনে জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না। যে কোন আন্দোলনের মূল শক্তি জনগণ। জনগণ সচেষ্ট হলে অস্রধারী পেশাদার সৈনিকের বিরুদ্ধেও জয় লাভ করতে পারে। যেমন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সিপাহী আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এ দেশের সাধারণ মানুষের অন্তরে স্বাধীনতার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন রোপণ করা সম্ভব হয়েছিল। তাই যখন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ লেখাপড়া করে শিক্ষিত হতে লাগলেন তখন তারা পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার মর্ম উপলব্ধি করতে শুরু করলেন। সচেতন মানুষ তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানাভাবে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার জন্য ভারতবর্ষের মানুষ যুগে যুগে রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। টিপু সুলতান, তীতুমীর, ঝাঁসীর রাণী ও আরো অনেকে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। যতীন দাস, ক্ষুদিরাম দাস, সূর্যসেন প্রীতিলতাদের মত কত মহৎপ্রাণ স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়েছেন। সে সময় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের মাধ্যমে জনগণকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়া হয়েছিল। ক্ষুদিরাম দাসের ফাঁসির গান নিয়ে রচিত “একবার বিদায় দে মা ঘুরে আমি, হাসি হাসি পরবো ফাঁসি দেখবে জগৎবাসী…”। গানটি অজস্র তরুণকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে উজ্জীবিত করেছিল। “মেঘনাদ বধ কাব্যে” প্রথম আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত “বাচন” চরিত্রের মাধ্যমে পরাধীনতার বেদনা ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রূপদান করেছিলেন। প্রথম আধুনিক ঔপন্যাসিক বংকিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের “বন্দে মাতরম” শব্দটি তরুণদের সংগ্রামে প্রেরণা দিতো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নজরুল ইসলামের গান, কবিতা ও সাহিত্য পরাধীন দেশের জনগণের অন্তরে আলোড়ন তুলেছিল। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রনাল রায়, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখদের নাটক ও নাটকে ব্যবহৃত অনেক সংগীত দর্শক ও শ্রোতাদের হৃদয়কে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত করে তুলেছিল। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী” গানটি আজও জনগণকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে। স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্র, বিভিন্ন নাটক, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম এর গান এবং অসংখ্য আধুনিক গায়ক–গায়িকার গান কিভাবে স্বাধীনতার আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নতুন প্রজন্ম উপলব্ধি করতে পারবে না।
ইংরেজরা প্রথম ভারতবর্ষের মানুষের মনে ধর্মের নামে বিভাজন সৃষ্টি করেছিল। যুগ যুগ ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ শান্তিতে বসবাস করে এসেছিল। ইংরেজরা বঙ্গ ভঙ্গের মাধ্যমে প্রথম জনগণের অন্তরে কলুষতা সৃষ্টি করেছিল নিজেদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য। তবু ইংরেজরা এদেশে শাসন ব্যবস্থা চালু রাখতে সক্ষম হয় না। তখন তারা ভারতবর্ষকে দু’ভাগ করে দিয়েছিল। যেখানে হিন্দু সম্প্রদায় বেশি সে রাজ্য ভারত আর যেখানে মুসলমান বেশি সে রাজ্য পাকিস্তান। এ বিভক্তিকরণ ভালো কি মন্দ তা জনগণ উপলব্ধি করতে পারে নি। তবে রাজনীতিবিদরা খুশি হয়েছিলেন। কারণ তাঁরা ক্ষমতার বসতে পেরেছিলেন। আর যারা স্বাধীনতার স্বপ্নকে পূরণ করতে সচেষ্ট ছিলেন, শহীদ হয়ে ছিলেন তাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করা সম্ভব হয় নি। কারণ ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ায় ভারতবর্ষের মাটি দাঙ্গার কারণে রক্তরঞ্জিত হয়েছিল। অনেকে বাধ্য হয়ে নিজের গ্রাম, দেশ, ভিটে বাড়ি ত্যাগ করে অন্য দেশে “রিফুউজি” নামে পরিচিত হয়েছিলেন। রাজা যায়, রাজা আসে। কিন্তু জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো।
কত আশা, সাধ– আহলাদ। শত শত বাঙালি ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে প্রাণ দিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শোষিত হতে লাগলো। আবার আন্দোলন। এবার ভাষার জন্য আন্দোলন। তারপর স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন। অবশেষে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন। কত মানুষ শহীদ হলেন, কত মা বোনের অশ্রু, কত মুক্তিযোদ্ধার রক্ত ! তবু তো বাঙালির মুখে হাসি ফুটেছিল। তারপর আর কি ! ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি!
বাঙালির ভাগ্যের লিখন কি সত্যি বদলাবে। সেই কবে মোগল আমলে বর্গীরা ধান কেটে নিয়ে যেতো। ইংরেজ আমলে অত্যাচার করে নীল চাষ করাতে বাধ্য করতো। জমিদারি প্রথা করে চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে কলকারখানার শ্রমিক হতে বাধ্য করেছিল। তাঁতীদের আঙ্গুল কেটে মসলিন তাঁতের কাপড় তৈরি বন্ধ করে ইংরেজদের কারখানার কাপড় জনগণকে ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কত অত্যাচার, শোষন জেলে, তাঁতী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ সহ্য করেছে। তারাই তো স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তবু আজও তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু তাঁরাই যুগে যুগে আন্দোলন করেন আর শহীদ হন। আগস্ট মাসের আন্দোলনে কত তরুণ প্রাণ চিরদিনের মত হারিয়ে গেলো। দেশ মুক্তির আনন্দে উদ্বেলিত। কিন্তু যাঁরা শহীদ হলো তাদের পরিবারের কী অবস্থা। যেসব নিরীহ সন্তান মৃত্যুবরণ করলো তাঁদের কি আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবে? সে সব পরিবারে দুঃখ চিরদিন থাকবে। সকালে কেউ নাস্তা খাবে না, দুপুরে খেতে বসে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করবে, ঈদের দিন কেউ নতুন কাপড় পরবে না, কেউ হাসি মুখে বলবে না মা সেমাই মজা হয়েছে। তারা অশ্রু লুকিয়ে হাসির চেষ্টা করবে। স্বজনহারার ব্যথা প্রত্যেক বাঙালি বোঝে, কারণ ১৯৭১ সালে প্রায় প্রত্যেক পরিবারের অনেক প্রিয়জন চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে। এ পৃথিবী দু’দিনের। সবার সুবুদ্ধি হোক। দেশে শান্তি বিরাজ করুক। সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা: “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে–ভাতে”। এ আশায় সবার এগিয়ে যাওয়া সফল হোক এ প্রত্যাশা আজ আমাদের সবার।
লেখক : কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক।