আমার দেখা নায়াগ্রা

শঙ্কর প্রসাদ দে | সোমবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৮:২৯ পূর্বাহ্ণ

ছোটকাল থেকে শুনে আসছি নায়াগ্রা জলপ্রপাত মূলত উপভোগ্য কানাডা থেকে। কথাটি মোটেও সত্য নয়। ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ভোর সাড়ে ছটায় চাইনিজ ট্যুরিস্ট বাসে আমাদের যাত্রা শুরু নিউইয়র্ক থেকে। ৪০৮.৪ মাইলের এই সড়কযাত্রায় অবাক হলাম শীতের গ্রাম দেখে। প্রায় ১০০ কি:মি: বেগে বাস এগিয়ে চলেছে। দু’পাশের ৯৫ ভাগ গাছ, ডালপালা হীন পাতাঝরা বিমর্ষ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাখির দেখা নেই, এরা যে কোথায় লুকিয়ে আত্মরক্ষা করছে জানি না। গুড়ি গুড়ি বরফ বৃক্ষ সারির বেঁচে থাকার লড়াইকে কঠিন করে তুলেছে। ঘন কুয়াশায় কীটপতঙ্গ, বন্যপ্রাণী, গবাদীপশু, লতাগুল্ম, ক্ষুদ্র ও বড় বৃক্ষসমাজ জড়োসড়ো, বিষণ্ন ও অস্বিত্ব টিকিয়ে থাকার লড়াইয়ে প্রাণান্ত সংগ্রামে লিপ্ত।

ভেবে অনুভব করতে চাইলাম ৬০ লাখ বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো তেলাপোকাসহ অসংখ্য অস্তন্যপায়ী প্রাণী ঘনবৃক্ষ আর সবুজ ঘাসে পৃথিবী ছিল উদ্ভিন্না যৌবনা। কথাবার্তা ছাড়া ১২ কিলোমিটার চওড়া এক গ্রহানু আঘাত হানলো মেক্সিকো উপকুলের ইউকাটান উপদ্বীপে। সৃষ্টি হলো ২০০ কিলোমিটার চওড়া ও কয়েক কিলোমিটার গভীর এক গর্ত। এই আঘাতে পৃথিবীর বায়ু মণ্ডলে ঘটে যাওয়া রাসায়নিক বিপর্যয়ের নাম সালফার সুনামী। মেক্সিকো উপসাগরের কিনারায় ঘুমিয়ে থাকা এই গর্ত থেকে ৩২৫ গিগাটন সালফার গোটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বেশ মোটা এক সালফার আস্তরণ সৃষ্টি করে। বহু দিনের জন্য সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পৌঁছা বন্ধ হয়ে যায়। লতাপাতা ঘাস গজানো কয়েক বছরের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশালাকার ডাইনোসরদের জন্য খাদ্য বলে আর কিছুই রইলো না। নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড, ওয়াশিংটন, দেলওয়ার, নিউজার্সি আর ম্যাচুয়েটসের প্রকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে এরকম আবহাওয়ায় ডাইনোসর মরেছে না খেয়ে। অসংখ্য অস্তন্যপায়ী প্রাণীও মরেছে ধুকে ধুকে। অথচ বেঁচে রইলো তেলাপোকা, যাই হোক সেটি ভিন্ন আলোচনা।

পৃথিবীতে প্রত্যেকটি ঘটনার ভালোমন্দ দু’টো দিক থাকে। ডাইনোসর যুগ সমাপ্তির পর এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়ের সূচনা হলো। স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বহু উত্থান পতনের পর মনুষ্য প্রজাতির সৃষ্টি। এরমধ্যে ঘটে গেল বহু প্রাকৃতিক নির্বাচন। বহু বিবর্তন। এখনো প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলেছে বিবর্তন প্রাণী কূলে আর মনুষ্য জগতে। দুপুরের লাঞ্চ শেষে বিকেল ৫টার দিকে পৌঁছলাম বাফেলোতে। একসময়কার ফরাসী উপনিবেশ শহরটি স্থলপথে কানাডায় বাণিজ্য ও পর্যটক আসা যাওয়ার জন্য প্রসিদ্ধ। স্থলবন্দরের সব সুবিধা নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের হোটেল রেস্টুরেন্টে ঠাসা ঝলমলে একশহর। সম্প্রতি নিউইয়র্কের কঠিন প্রতিযোগিতা এড়িয়ে বহু বাঙালি গড়ে তুলছে ব্যবসা বাণিজ্য এমনকি কোচিং সেন্টার।

হায়দ্রাবাদ রেস্টুরেন্টে দম বিরানী দিয়ে ডিনার শেষে এক চক্করে দেখে নিলাম বাফেলো শহর। সন্ধ্যে ৭ টায় পৌঁছে গেলাম একেবারে নায়াগ্রা ঝর্নার পাদদেশে। বুঝলাম, আমেরিকান অংশ থেকে নায়াগ্রা পুরোটাই দেখা যায়। সন্ধ্যে ঠিক ৮ টায় কানাডার নায়াগ্রা অংশে শুরু হল আতশ বাজির দিগন্ত বিস্তৃত ফায়ার ডিসপ্লে। রংয়ের যে শেষ নেই, কোথাও জলস্রোত নীল, কোথাও হলুদ, কোথাও লাল, কোথাও ধবধবে সাদা। কানাডা অংশে আলোর বিন্যাস পুরো জলপ্রপাতকে করে তুলে নান্দনিক, মোহনীয়, মুগ্ধকর। মোটামুটি ১ কিলোমিটার বিস্তৃত এই ঝর্ণাধারা আমেরিকা এবং কানাডার শীর্ষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।

রাতের নায়াগ্রা দেখার শেষ স্পট হলো নিকোলা টেসলার স্ট্যাচু। সার্বিয়ান এই বিজ্ঞানী নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখে মার্কিন সরকারের কাছে প্রথম বাণিজ্যিক জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দেন এবং এই জলবিদ্যুৎ দিয়েই টেসলা আজকের দিনের ব্যবহৃত এসি কারেন্ট (অলটারনেটিভ কারেন্ট) ব্যবহার ১৯৭৯ সালে দুরবর্তী স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। ঝর্ণাধারার কোলে নিকোলা টেসলার প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, এই বিজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে বলেই আমাদের জীবন আজ এতো স্বচ্ছন্দ। রাত ১০ টায় ঘুমিয়ে পড়লাম। ২৯ ডিসেম্বর ঠিক ৬.১০ মিনিটে শুরু হল দিনের ঝর্না দেখা। প্রথমেই পৌঁছে গেলাম আমেরিকান অংশে মূল জলধারার নিচে। প্রায় ৩ মিটার উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে বিলিয়ন বিলিয়ন মিস্টি জল। প্রবল বাতাসে আপনি ভিজে যাবেন। বিশেষভাবে তৈরী জ্যাকেট ছাড়া ঝর্না তলায় যাবার প্রশ্নই আসে না। ১০টার দিকে দেখানো হল শর্ট ফিল্ম, অল্প সময়ের মধ্যে দেখানো হল কিভাবে থমাস এডিসনের ডিসি কারেন্টের বিরোধীতা করে টেসলা এসি কারেন্ট আবিষ্কার করেছিলেন।

একেবারে ফেরার পথে শেষ বিন্দু হল খুব কাছ থেকে কানাডিয়ান ঝর্নাধারা উপভোগ করা। কানাডিয়ান সাইট আমেরিকান সাইডের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৭৯০ মিটার। একেবারে অনুচ্চ অর্থাৎ নদী স্রোত থেকে ৭মিটার উচ্চতায় (যা পর্যটকদের নয়ন সম্মুখ থেকে) অদৃশ্য উৎস পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সুভ্রতার স্নিগ্ধতা নিয়ে নিরন্তর নিরবধি ঘোড়ার পদচিহ্নের আকৃতি বলে নায়াগ্রা ফলসের কানাডিয়ান অংশের অপর নাম ‘হর্ষশু’।

দুপুরে লাঞ্চ শেষে মোটামুটি ১২ টার দিকে ফেরার পালা। নিউইয়র্ক শহরে ঢুকতেই দেখলাম দীর্ঘ ও বিরক্তিকর ট্রাফিক জ্যাম। তিন ঘণ্টা লাগলো ৩০ মিনিটের পথ ম্যানহার্টন পৌঁছতে। দীর্ঘসময় ধরে এডভোকেট রঞ্জন দে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিষণ্ন চেহারায়, ম্যানহাটন থেকে বাঙালি পাড়া জ্যাকসন হাইটস্‌ বড় জোর ১৫ মিনিটের দূরত্ব। অথচ লাগল দু’ঘণ্টা। হলফ করে বলতে পারি নিউইয়র্কের ট্রাফিক জ্যাম কোনও অংশেই ঢাকা থেকে কম নয় বা স্বস্তিদায়ক নয়। বুঝলাম, আমার জন্মভূমির সবকিছু খারাপ এটাও ঠিক নয়।

লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের শুঁটকি-সম্ভাবনাময় রপ্তানিখাত
পরবর্তী নিবন্ধকবি ওহীদুল আলম ও তাঁর পূর্বপুরুষ