দেশপ্রেম মানে কোন একটি ভূখণ্ডের নদীনালা, পাহাড়, সমুদ্র, গাছ–গাছালি, পাখ–পাখালি ইত্যাদির প্রতি প্রেম নয়। দেশপ্রেম মানে হওয়া উচিত দেশের মানুষের প্রতি প্রেম; লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ–মানুষের প্রতি ভালোবাসা। আমরা সকলেই জানি রাষ্ট্রের একটি প্রধানতম উপাদান হল জনসমষ্টি। এই জনসমষ্টিকে বাদ দিয়ে শুধু কতকগুলি প্রাণহীন নদী–নালা, খাল–বিল, পাহাড়–পর্বত আর মাটির প্রতি ভালবাসা সৃষ্টিকে আর যাই বলা হোক, ‘দেশপ্রেম’ বলে অভিহিত করার কোন যৌক্তিকতা নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি। আমাদের চারদিকে আজ মানুষ রক্ষা নয়, দেশরক্ষার সমবেত সঙ্গীত। দেশপ্রেমের সংকীর্ণ চোরাগলিতে এসে মানুষ হারিয়ে গেছে। বড় হয়েছে ভূখণ্ড, তথাকথিত জাতি, ধর্মীয় চেতনা ইত্যাদি। ওদিকে ‘মানুষ’ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অকাতরে মার খাচ্ছে। আদিবাসীরা মার খাচ্ছে, হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিস্টানরা মার খাচ্ছে, হরিজন–দলিতরা মার খাচ্ছে, সম্পদের দিক থেকে যারা প্রান্তিক, সংখ্যালঘু– তারা মার খাচ্ছে। মানবতাহীন ‘দেশপ্রেমের’ এই চেতনা দেশের প্রান্তিক মানুষদের ‘দেশছাড়া’ হতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ ও মদদ যোগাচ্ছে। উস্কানি দিচ্ছে। দেশ মানে শুধু মাটি, পতাকা আর সীমানা নয়। মানুষ নিয়েই আসল দেশ। সেখানেই যদি গোলমাল থাকে তবে সেই দেশ থাকলেই কী আর না থাকলেই কী। ওই রকম দেশপ্রেমের কোন মূল্য নেই, মূল্য থাকতে পারে না। মানুষ দেশের কাছে দায়বদ্ধ না, বরং দেশই মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। যে নাগরিক তার দেশের কাছ থেকে নিরাপত্তা পায় না, নাগরিক হিসাবে সম্মান পায় না, সে কোন দুঃখে সেই দেশের কথা বলবে? সেই দেশের প্রতি ভালবাসা দেখাবে? গোল্লায় যাক না সেই দেশ। দেশ কীরকম হওয়া উচিত সেটা নিয়ে লোপামুদ্রার অসাধারণ একটা গান আছে। সেই গানের কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ‘এ মানচিত্র জ্বলছে জ্বলুক, এই দাবানল পোড়াক চোখ, আমার কাছে দেশ মানে এক লোকের পাশে অন্য লোক।’