বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করার পূর্বে বাঙালি জাতির উপর অতীতের শোষণ ও নিপীড়নের ইতিহাস তুলে ধরা প্রয়োজন। বৃটিশরা পাক–ভারত নামক উপমহাদেশে প্রায় দুইশত বছর তাদের শাসন শোষণ নিপীড়ন চালিয়ে এদেশকে গোলামীর জিঞ্জির পড়িয়ে রেখেছিল। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ‘লাহোর প্রস্তাব’ এর আলোচনা অনুযায়ী মুসলমানদের সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে দুটি দেশ এবং অপরটি ভারত নামের নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হবে। কিন্তু ৪৭এর ১৪ আগস্ট মুসলমান অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান এবং বাকি অঞ্চলটিকে ভারত নামক আলাদা দুটো রাষ্ট্র বৃটিশ শাসন মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করে। জনসংখ্যা, শিক্ষাদীক্ষায় পূর্বাঞ্চলের জনগণ এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ২৪ বছর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী চালিয়েছে নির্মম শাসন, শোষণ ও নির্যাতন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রত্যাশা ছিল তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে হলো ঠিক তার উল্টোটা। সব কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ ছিল শতকরা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। জাতীয় বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে আর ২৫ শতাংশ ব্যয় হতো পূর্ব পাকিস্তানে যদিও পূর্ব পাকিস্তান থেকে সর্বাধিক রাজস্ব আদায় হতো শতকরা ৬২ শতাংশ। এর চেয়ে লক্ষ্যণীয় বৈষম্য ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি। অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে ভয়াবহ নিপীড়ন ছিল একটি অঞ্চলের জাতির ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপর নির্মম আগ্রাসন। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী বাঙালির প্রাণের ভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। ২১ মার্চ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা গভর্নর জেনারেল কায়েদ ই আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেছিলেন ‘উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা’। সাথে সাথে পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ ও আপামর জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরপর আবারো ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি একমাত্র উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দেন। সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদে তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সহগ্র ছাত্র জনতার না না ধ্বনিতে সমাবর্তনস্থল প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশের নির্বিচার গুলি বর্ষণে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জাব্বার ও আরো অনেকের বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। জনতার সংগ্রাম ও মাতৃভাষার আন্দোলনকে থামাতে না পেরে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শেষপর্যন্ত ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাঙালির স্বাধীনতার মূলমন্ত্র নিহিত ছিল। বাঙালির আত্ম পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অনুপ্রেরণা ছিল একুশের চেতনা। একুশের চেতনাকে সামনে রেখে বাঙালির জীবনে ঘটে থাকে ১৯৫৪এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮এর সামরিক শাসন, ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ এর ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০ এর দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন এবং সর্বশেষ ৭১ এর অসহযোগ আন্দোলন ও বাঙালির রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৬৯ এর ৫ জানুয়ারি ৬ দফা ও ১১ দফার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম অভ্যুত্থানেরূপ নিলে ২২ ফেব্রুয়ারি পাক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান কে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩১০ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের ম্যান্ডেট লাভ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক দল বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান‘ এর নেতৃত্বে সরকার গঠনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দলমত নির্বিশেষে বাঙালি এ চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয় বাঙালির অধিকার রক্ষার সংগ্রাম। এরই ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৭মার্চ ১৯৭১ এ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সর্ববৃহৎ জনসভার আয়োজন করা হয়। ৭ মার্চ ১৯৭১এ রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে ১৯ মিনিটের এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল স্বাধীনতার পূর্ব ঘোষণা। সেদিনের উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ। বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্র নায়ক ও বিশ্বনেতৃবৃন্দের ভাষণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত যেটিকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট পৃথিবীর ইতিহাসে এক নৃশংসতম গণহত্যার নাম। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। ১৭ এপ্রিল ৭১ এ মেহেরপুরের মুজিব নগরে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়।
সারা বাংলায় পাক বাহিনীর নির্মম গণহত্যা মানব সভ্যতার ইতিহাসকে কালিমালিপ্ত করেছিল। ওদিকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পূর্বেই তিনি ওয়ারল্যাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬ মার্চ কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি বারবার পাঠ করেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম.এ. হান্নান। পরদিন ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন সেনাবাহিনীর তদানীন্তন মেজর জিয়াউর রহমান। বৈষম্য হীন সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের চেতনা থেকেই বাঙালি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে নিরস্ত্র অবস্থান থেকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বান ছিল ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করবে’। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ঢাকার রাজপথ থেকে গ্রাম বাংলার প্রতিটি প্রান্তর শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ থেকে গ্রামবাংলার নিরিহ জনগণও রেহাই পায়নি। প্রায় এক কোটিরও বেশি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। শরণার্থীদের বিরাট চাপ, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কাজে ভারতের আপামর জনগণ ও মহৎ হৃদয়ের অধিকারী জন নন্দিত বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী ও সময়োপযোগী সহযোগিতা বাঙালি যুগ যুগ ধরে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বলিষ্ঠ সমর্থন নিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানি জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের নিকট জোরালো দাবি জানিয়ে আসছিল।
‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান, ২ লক্ষের অধিক মা–বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধীনতা এক গৌরবময় বিজয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছিল। নরখাদক ইয়াহিয়া, ভুট্টো, রাও ফরমান আলী, নিয়াজি, টিক্কা খানের পাপের প্রায়শ্চিত্ত বাংলার মাটিতেই হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিত্র বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর সশস্ত্র অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা ও ভাইস মার্শাল এ.কে.খোন্দকারের হাতে হানাদার বাহিনীর কুখ্যাত জেনারেল নিয়াজির নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঙালির দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে। লাল সবুজের পতাকা বুকে নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয় বাঙালির বিজয়ের অহংকার। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসে যার নাম উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো দেদীপ্যমান তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আজ একই সুতোতে বাঁধা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বাধীনতা আমাদের জাতীয় জীবনের মহান অর্জন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বে মিশে আছে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মদান, দুলক্ষ মা–বোনের সম্ভ্রম হারানোর বেদনা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কঠোর সংগ্রামী জীবনের স্মৃতি ও মহান আত্মোৎসর্গের ইতিহাস। মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দেশপ্রেম, ভালোবাসা এবং ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে, আর তাতেই পূর্ণ হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লালিত স্বপ্ন।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনীয়া সরকারি কলেজ।