আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল, বৈষম্যহীন ও অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। যেখানে জাতি, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাবে। তরুণরা এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে মানুষের একতা ও দেশপ্রেমই হবে উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। ধনীগরিব নির্বিশেষে সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে চলবে। বিপদে পাশে থাকবে একে অপরের। অপরাধীকে অপরাধের চোখেই দেখবে। যে কেউ কোনো অন্যায় কিংবা অপকর্ম করে টাকা আর ক্ষমতার দাপটে পার পেয়ে যাবে, সেই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি চায় তরুণ সমাজ।

২০২৪ এর জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই উপমহাদেশের ইতিহাসেও অনন্য ইতিহাস হয়ে থাকবে। শুরুতেই সরকারি চাকরিতে সাম্যের দাবি নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন পরবর্তীতে রাজনৈতিক রূপে অবির্ভূত হয়ে গণঅভ্যূত্থানে রূপ নেয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে সেনাবাহিনীর রক্তপাতহীন বিমুখতায় শেখ হাসিনার সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়। আন্দোলনকালিন সময়ে সরকারের কঠোর নীতির ফলে ঘটে যাওয়া ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ সেই তারুণ্য জেগেছিল এবং স্লোগানে স্লোগানে উন্মুক্ত হয়ে বলেছে, ‘জেগেছেরে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’। কিন্তু আমাদের ইতিহাসের ভেতরেই যে কত হিংসা দ্বেষের উদাহরণ! কবিগুরু বলেছেন, ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি’। আমরা আমাদের বয়সে দেখেছি, ডাকাত সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে, পকেটমার সন্দেহে জনতা যে কী হিংস্রভাবে মানুষ হত্যা করে নৃশংসতার ও বর্বরতা কতভাবে হতে পারে তা আমরা দেখেছি, অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। জনপদে জনপদে মারাত্মক লাঠিসোঁটাটোঁটার লড়াই হয়। প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঘটে রক্তপাত। এর থেকে উত্তোরণের জন্য সভ্য সমাজ তৈরি হয় শিক্ষার মধ্য দিয়ে।

স্কুলকলেজবিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বিদ্যার্জন করে আমাদের তরুণদের মাঝে জন্ম নেয়ার কথা মানবিকতা, ধৈর্য, ঔদার্য্য, সহমর্মিতা, ভালোবাসা ও ত্যাগের আনন্দ।

২০২৪ আগস্ট মাসের প্রথম দিকে বিগত সরকারের বিদায়ের পর পর যে সংখ্যায় ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে তা হিসাব করে শেষ করা যাচ্ছে না। পূর্বের সরকারের নিপীড়নের পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়ায় কিছু ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এর সবই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়। সুযোগসন্ধানী লুটেরারা ছিল, দুর্বৃত্তরা ছিল। কোনো কোনো স্থাপনায় আগুন দিয়ে লুটপাট করতে ঢুকে দূর্বৃত্তরা নিজেরাও পুড়ে মারা গেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে হঠাৎ লুটেরা হয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল। আবার টার্গেট করে লক্ষ্য হাসিলের অপচেষ্টাও ছিল।

দেশে একটা বিপ্লব ঘটেছে, এই বিপুল তারুণ্যের শক্তি সুন্দরের পথে চালিত হয়ে আমাদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর করে তুলতে পারে। কিন্তু সুন্দর এ অর্জনকে বাঙালির চিরকালীন ঈর্ষা, দ্বন্দ্ব, চাতুর্য, দুর্নীতি, ক্ষমতাস্বার্থ, হানাহানি, স্বৈরাচার, মনোবৃত্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না।

আগস্ট মাসের ক্ষমতা পরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ও প্রতিষ্ঠানে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে যা ঘটে চলেছে তা স্বাভাবিক ন্যায়নীতি, আইনকানুন সম্মত কিনা? মানবতামানবিকতা এখানে ভুলুন্ঠিত হচ্ছে কিনা? ভেবে দেখা দরকার। আমরা কি আবারও পুরানো অন্ধকার যুগে ফিরে যাচ্ছি? চিন্তা করার সময় এসেছে। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে পৃথিবী ভারাক্রান্ত হলে; প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড়, ভারী বর্ষণ, সাইক্লোন, শিলাবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, শুষ্কতা, প্রবল বাতাস, ভূমিকম্প, সাগরের পানি বিপদ সীমায় পৌঁছে যাওয়া, নদনদীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ ক্ষতির প্রাবল্য প্রভৃতি সমাজে দেশে, রাষ্ট্রে দেখা দেয়।

পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও সমুদ্রে বিপর্যয় প্রকাশ পায়। যার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তা তাদের কৃতকর্মের স্বাদ তাদের আস্বাদন করান। যাতে তারা সুপথে ফিরে আসে।’

তোমাদের ওপর যেসব বিপদআপদ আপতিত হয়, তা তোমাদেরই কর্মফল।’ দেশের ক্ষমতার পটপরিবর্তন আমরা দেখেছি। কিন্তু সিস্টেমের পরিবর্তন দেখা যায়নি। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষাসংস্কৃতি, শিল্পবাণিজ্যসহ সর্বত্র কাজের ক্ষেত্রে খুবই কম মানুষকেই প্রচলিত আইন মেনে চলতে দেখা যায়। প্রতারণা, জালিয়াতি, চুরিসহ নানা বেআইনী কাজ যেন সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণে বিশেষ বাহিনী ও সংস্থা থাকলেও কিছুুতেই অপরাধ কমানো যায়নি বা যাচ্ছে না। এসব বাহিনী ও সংস্থার কাছে সাধারণ মানুষই নিগৃহীত হয়েছে বা হচ্ছে বেশি।

সম্প্রতি অন্তর্বতী সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমরা যদি আইন অনুযায়ী কাজ করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবে দুর্নীতি বা অনিয়ম থাকবে না। আইনের মধ্যে থেকে কাজ করলে দুর্নীতিতে বড় বাধা আসবে। আইন থেকে বিচ্যুত হলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে কাজটি। দেশ থেকে দুর্নীতি একেবারে নির্মূল সম্ভব নয়। দুর্নীতি সব দেশেই কিছু না কিছু আছে। তবে নৈতিকতাবোধ ও বৈষম্যহীনতা মাথায় রেখে অন্তত মূলনীতি ঠিক করে দেওয়া গেলে এবং ধারাবাহিকতায় দেশ এগিয়ে গেলে তাহলে দুর্নীতিকে কমিয়ে আনা সম্ভব। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সবারই উচিত দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলা। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আদালত থাকা সত্ত্বেও আইনের শাসন মানার সংস্কৃতি এখনো পুরোপুরি গড়ে উঠেনি। মানুষ আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয় এবং তারা যখন ইচ্ছা তখন আইন অমান্য করে। ফলে সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে দিন দিন বাড়ছে সামাজিকরাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অপরাধপ্রবণতা। এছাড়া সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালত বা সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল ঢালাওভাবে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা দেওয়া এবং নিজেদের পক্ষের লোকের মামলাগুলো এবং শাস্তি থেকে ঢালাও প্রত্যাহার একটি সভ্য সমাজের জন্য সুখকর নয়।

সুতরাং আমাদের সকল পক্ষেরই উচিত নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং দেশের উন্নয়নের স্বার্থে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মেনে চলা। এতে একদিকে যেমন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তেমনি দেশের উন্নয়ন অগ্রগতিও ত্বরান্বিত হবে। সমাজের সর্বক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ এবং তা মেনে চলা সকলেরই কাম্য।

দেশের শৃঙ্খলা রক্ষা ও অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ়করণের অন্যতম চালিকাশক্তি আইন। বিচারব্যবস্থা হচ্ছে সভ্যতার বিশেষ অবদান। সমাজ পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে আইন গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সমাজের শ্রেণিবৈষম্য দূর করতে এবং দুর্বল ও অসহায় শ্রেণির নিরাপত্তায় বিচারব্যবস্থা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাই আইন অমান্য করার অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের সবারই বেরিয়ে আসা এবং সমাজের সর্বত্র আইন মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। পাশাপাশি, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়দায়িত্ব যাদের, তাদের ন্যায়নিষ্ঠ ভূমিকা আন্তরিকতার সঙ্গে পালনও জরুরী। এরজন্য প্রয়োজন সামাজিক উদ্যোগ ও সচেতনতা। বর্তমানে আইন বিভাগের প্রতি আস্থা এবং ত্বরিত গতিতে দ্রুত আইনের প্রয়োগ এবং আইন রক্ষাকারিদের অবস্থান এবং ব্যবহার দেখে সাধারণ মানুষ বিচলিত ভীতশ্রদ্ধ। এ দুর্বৃত্তায়ন হতে বের হওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে বলতে চাই, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে জনগণের মতামত ও স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুষ্ঠু আইনকাঠামোর ভিত্তিতে আদর্শ শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। যাতে সব শ্রেণির মানুষের জন্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত হয়।

তারুণ্যের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতে হলে পুরো ব্যবস্থাটাকেই ঢেলে সাজাতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে নিজেদের মনমানসিকতায় ও আচারআচরণে। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তবেই কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। পরিশেষে শুধু বলব, ইতিহাসের শিক্ষা, ইতিহাস হতে কেউ শিক্ষা নেয় না।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ : নারী জাগরণের পথিকৃৎ
পরবর্তী নিবন্ধআনন্দলোকে মঙ্গলালোকে