আমাদের সামাজিক পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন

ছন্দা চক্রবর্তী | শনিবার , ৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:১৫ পূর্বাহ্ণ

চন্দন গাছ থেকে আমরা সুগন্ধ পেয়ে থাকি, সুগন্ধ তখনি পাই যখন একে পাথরে রেখে ঘষতে থাকি। চন্দন গাছকে যখন কাটা হয় তখন তা হয় চন্দনকাঠ, এই কাটা অংশে হয়তো সুঘ্রাণ পাওয়া যায়, কিন্তু জীবন্ত চন্দন গাছে কোন সুঘ্রাণ থাকে না। চন্দন গাছের সারি আছে বা চন্দন গাছের বনের মধ্য দিয়ে হাঁটতে থাকলে কোনো সুগন্ধ পাওয়া যায় না। তবে ছায়া প্রদান করে থাকে। অথচ একটা ছোট্ট চন্দনকাঠকে যখন পাথরে রেখে ঘষতে শুরু করা হয় তখন নিজে বিলীন হতে থাকে আর তার বিনিময়ে দিতে থাকে এক অপূর্ব শান্তিময় স্নিগ্ধ সুঘ্রাণ। তাইতো গুরুজনেরা ছোটদের আশীর্বাদ করতে বলতেন, তোমাদের জীবন হোক চন্দনের মতো’। অর্থাৎ বড়রা বলতে চান তাদের জীবন এমনভাবে গড়ে উঠুক যেন অপরের জন্য এত ত্যাগ করা হোক যে, নিজের স্বার্থ চিন্তা না করে অপরের জন্য নিজে উৎসর্গিত হয়ে সুবাসিত জীবনের অধিকারী হওয়া যায় ।

কিন্তু বর্তমান অবস্থা এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন সন্তানেরা এসব আশীর্বাদ হয়তো শোনেইনি বা কখনো আশাও করে না। কারণ তারা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। পরিবেশ, সময় এসবের পরিবর্তন এসে মাবাবাদের জীবনযাপন প্রণালী থেকে শুরু করে সন্তানদের লালনপালন, শিক্ষাপদ্ধতি, আদেশ উপদেশ প্রদান, পরিচর্যা, রুচিবোধ সব কিছু প্রযুক্তিবিদ্যার আগ্রাসী ঢেউএর তোড়ে যেন ভাসমান ভেলায় চেপে চলছে। বেবি বুমার্স প্রজন্ম অর্থাৎ অনেক ভাইবোন সমেত পরিবারগুলো বা যৌথ পরিবার যেভাবে সেয়ারিং এবং কেয়ারিং এর মাধ্যমে বড় হয়েছে সেসব চর্চা এখন সুদূর পরাহত। আর ষে জন্যই আপন সিবলিং এর জন্যও কোনো মানবিক বোধ কাজ করে না। বর্তমান চারপাশের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর দিকে তাকালেও বোঝা যায় সন্তানদের নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর প্রতিযোগিতায় মাবাবা এবং সন্তান উভয় দিকে চলছে এক প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়। কাকে কে ঠেক্কা দিবে তার দৌড় প্রতিযোগিতা। তার ফল হিসাবে সৃষ্টি হচ্ছে অমানবিক ও নির্দয় সন্তান। সে সন্তানের নিজের মাবাবার কঠোর পরিশ্রম এর ব্যাপারকে যে সাধারণ ব্যাপার বলে মনে করে, সন্তান তার মা বাবার এ ত্যাগকে কৃতজ্ঞচিত্তে ধারণ করার মতো পারিবারিক শিক্ষা পায় না, এ দায় কার ? মাবাবার না সময়ের না প্রযুক্তির?

এই প্রেক্ষিতে চন্দন গাছের উদাহারণ প্রযোজ্য, চন্দন গাছ যখন জীবিত ছিল তখন শুধু ছায়া প্রদান করে যায়, যখন তাকে কেটে কাট বানানো হয় এবং পাথরে ঘর্ষিত হয় তখন চারদিক সুবাসিত হয়। মাবাবারাও বর্তমান প্রযুক্তির যুগের সন্তানের জীবনে তেমন। যখন মাবাবারা জীবিত থাকে সন্তানকে চারপাশের ঝঞ্ঝাট থেকে আগলে রাখে, সন্তানকে বুঝতেও দেয় না যে তাদের চারপাশে এবং মাথার উপর ছাতা হয়ে থাকে, আর যখন মৃত্যু হয়, তখন বুঝতে পারে মাবাবাদের অবদান সন্তানকে কতখানি সুবাসিত করেছে। মাবাবা কে হারানোর পর হয়তো কারো অন্তর্বেদনা পাথরে মাথাকুটার মতো আর্তনাদ হয় কিন্তু তখন আর করার কিছু থাকে না চারদিকে শুধু পিতা মাতার সুবাসিত প্রচেষ্টা, যা সন্তানকে আগলে রাখার প্রয়াস, সেটা হোক সফল সন্তান বা বকে যাওয়া সন্তান। সন্তানদের জীবনের ক্ষেত্রে মাবাবারা চিরকাল চন্দন গাছ।

চন্দন গাছরূপী এই মধ্যবিত্ত মাবাবাদের কঠিন আত্মত্যাগের ফলেই এক একটি সফল সন্তানের জীবন গড়ে ওঠে। সন্তান বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিয়ে করে, তার পর সংসার হয়। সেই সংসারগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বৌমারা বোমার চরিত্র ধারণ করে। যত শিক্ষিতই হোক না কেন, নিজের যত্নে, কষ্টে সৃষ্টে লালনপালন করা সন্তান এর সংসারে শুধু অপাঙতেয় হয়ে বেঁচে থাকা। এক্ষেত্রে মেয়ে সন্তানেরা মাবাবার খেয়াল রাখার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। বিদেশে মেয়ের মাবাবাদের কদর কিছুটা হলেও থাকে, ছেলের মাবাবার তুলনায়। ছেলের বঊকে খুশী রাখার জন্য, বা সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য, অনেক সন্তান এর মাবাবার জন্য শুধু নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। কতো বাস্তব গল্প আমাদের চারপাশে রয়েছে। ছেলের মাবাবাদের একটা তৃপ্তি সন্তান উন্নত দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মা যে দিনরাত ছেলে সুখে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করেছে, ঈশ্বর শুধু সেই প্রার্থনা পূরণ করেছে মাবাবার চোখের জলের বিনিময়ে। শৈশবের সব শিক্ষা ভুলে উন্নত দেশের উন্নত শিক্ষায় নিজের সংসার, সংসারের আর্থিক যোগান, এসব বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন জীবনসঙ্গীনির ভালোবাসার কূটচালে পরাস্ত হয়ে হার মেনে ভুলে থাকতে হয় তার অতীতের কথা, মাবাবার কথা, ভাইবোনেরা তো স্মরণ সিলেবাসে থাকেই না। একসময় হয়তো একটা স্থিত অবস্থায় আসে, মাবাবার জন্য কিছু করতে সুযোগ সৃষ্টি হয়, কিন্তু ততদিনে দেরী হয়ে যায়, কোনো মাবাবা অসহায়ত্বের বেদনা নিয়ে পরপারে পাড়ি জমায়, কোনো কোনো মাবাবা একা হয়ে যান, আবার কোনো কোনো মাবাবা ছেলের অবহেলা সইতে না পেরে রোগে শোকে কাতর হয়ে পড়ে এমন অবস্থা হয়, অসুস্থ শরীর ভ্রমণের ঝক্কি পোহাবার অবস্থায় থাকে না।

এক প্রতিবেশীর মায়ের মৃত্যুতে এ উপলব্ধি বুঝতে পারলাম, প্রতিষ্ঠিত ছেলে আজ থেকে ২০ বছর আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উন্নত দেশে, মাবাবার লুকানো স্বপ্ন তো থাকবেই, ছেলেরও স্বপ্ন ছিল মাবাবাকে নিয়ে তাদের সাথে রাখবে, এর ভিতর মাঅন্ত প্রাণ ছেলে বেশ কয়েকবার এসে এসে মাবাবাকে দেখে দেখে গিয়েছে, কিন্তু নানা পারিবারিক কারণে নিতে পারে নি। অদম্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মাবাবাকে নিয়ে মাবাবার অবদানে বড় হওয়া সন্তান নিজের আস্তানাকে মাবাবারও আস্তানা এটা দেখাতে আকাশে ওড়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে পারল না। সন্তানের সন্তানও ১৮ বছরের ঊর্দ্ধে। এতদিন পর অশীতিপর বৃদ্ধ বাবাও প্রায় ৭৫ বয়েসী। মাবাবাকে নিজের বিদেশের বাড়িতে নেওয়ার টিকিট কেটেছে। কিন্তু সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়, কথায় আছে,‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। বিমানে ওড়ার ১৫ দিন আগে কম অসুস্থ ৭৫ বয়েসী মা হঠাৎ শারীরিক ভাবে দুর্বল হয়ে মৃত্যুবরন করলেন, মায়ের আদরের সন্তান মা কে দেখাতে পারলো না তার উন্নত দেশের উন্নত জীবন, সন্তানের আহাজারি, বুকভরা বেদনা নিয়ে শূধু অশীতিপর বাবাকে নিয়ে উড়াল দিল নিজের উন্নত ঠিকানায়। এ দায় কার? ভাগ্যের? , মোটেই নয়। এভাবে চন্দন বৃক্ষ মরে গিয়ে সুভাষিত হচ্ছে হাজারো সন্তানের উন্নত জীবন। মিলেনিয়াম প্রজন্মে এসব উদাহরণের ছড়াছড়ি। আর সামনে চলমান জেনারেশন জী প্রজন্ম তো আরো ভয়াবহ।

জেন জী প্রজন্ম পরিবারের এক মেয়ের বিয়ের গল্প, বাস্তব চোখে দেখা এসব মডার্ন মেয়ের বিয়ের ব্যাপারের ভাবনায় যে কী পরিমান অভব্য চিন্তাচেতনা এরা ধারণ করে বড় হচ্ছে তা আমার আপনার বা সাধারণ মানুষকে হতবাক করে দিতে বাধ্য। মেয়ের ইচ্ছার বাইরে মাবাবার কোনো ইচ্ছার বহিপ্রকাশ আজকালকার বিয়েতে ঘটে না, এমনকি পারলে হবু শ্বশুর শাশুড়ীর পরিবারও হবু বৌমার কথা মতো চলতে হয়, আচ্ছা সেটাকে ঠিক ভাবে মানা যায়, ধরে নেওয়া যায় সুন্দর পরিকল্পনা মাফিক বিয়ের আয়োজনতো সবার আনন্দের জন্য, সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এর আর এক সংস্করণ দেখলাম, আর একটি ব্যাপারে, সেটি হলো, মেয়ে তার নিজের বাবাকে বলছে, যাতে বিয়ের পাত্রীর পরনের শাড়ি চেয়ে যেন বিয়ে মন্ডপে আসা আমন্ত্রিত অতিথিদের পোশাক কম দামের এবং কম মানের হয়। বাবা চিন্তায় পড়ে গেল, সেটা কী করে সম্ভব! তখন মেয়ে বলছে নিমন্ত্রণ পত্রে লিখে দিতে, পরে মেয়ের মাবাবা বুদ্ধি করে এটা আর করে নি, কিন্তু যারা লাল বেনারসী পড়ে বিয়েতে উপস্থিত হয়েছে তাদের কৌশল করে ঢোকা থেকে বিরত রেখেছে মন্ডপে। তবুও যারা পাত্রীর কাছে বৌদি সম্পর্কিত যারা ছিল তাদেরকে এভয়েড কড়ে থেকেছে, এতে নাকি পাত্রীর সৌন্দর্যে ভাটা পড়ে, ভাবুন আমাদের মেধাবী প্রজন্ম কোন দিকে যায়, বা এর উৎসই বা কী? আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি একটা গাজাখোরি তথ্য দিলাম, না এটা আমার চোখের সামনেই ঘটেছে এসব নীরব বেয়াদবি, আমাদের সামাজিক পরিবেশ এখন ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়ে এগোচ্ছে না পেছাচ্ছে, কোনো সদুত্তর নেই। আমাদের আদরে লালিত সন্তানদের মূল্যবোধ শিখাতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি কেন?

লেখক: প্রাবন্ধিক, সাবেক অধ্যক্ষহুলাইন ছালেহনূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমাতে আসক্তি
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে