১৫ এপ্রিল ২৪। সোনালী ব্যাংক চকবাজার শাখা থেকে বের হয়ে গুলজার মোড়ের দিকে ফিরতেই শিশির ডাক শুনে পেছন ফিরে তাকাই। দেখি প্রফেসর সবুক্তগীন মাহমুদ স্যার। রিক্সায় একটা ছেলেকে নিয়ে আমার দিকেই আসছেন। আমি দাঁড়িয়ে। কাছে আসতেই সালাম জানিয়ে জানতে চাইলাম তিনি কোথায় যাচ্ছেন? বললেন সেলুনে। চুল বড় হয়েছে, সেভও করতে হবে। আমি সেলুনে যেতে চাইলে বারণ করলেন। বললেন তোমার কাজে যাও। আমি একাই পারবো।
মমতায় মোড়ানো কণ্ঠ আর কোনো দিন শুনতে পাবো না। স্যারের সাথে আমার পরিচয় আশির দশকে। স্যার তখন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ চট্টগ্রামের সহকারী অধ্যাপক (ভূগোল)। প্রাণবন্ত সুপুরুষ। আদর্শ শিক্ষক। ক্লাসরুম অন্তঃপ্রাণ শিক্ষক। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে শিক্ষাপোকরণ ও বোর্ড ব্যবহার করে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা ছিল তাঁর একটা বিশেষ যোগ্যতা। সেই থেকে শুরু। শেষ দিন অবধি সন্তানসম স্নেহের বাঁধনে বেঁধে রেখেছিলেন পরম ভালোবাসায়।
আমি যখন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ফেনীতে যোগদান করি ১৯৯৭ সালে তখন তিনি সেখানকার সহযোগী অধ্যাপক। আমরা একই ডরমিটরিতে থাকতাম। তিনি প্রতিদিন ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠতেন। দিনের কাজের একটা তালিকা লিখে রাখতেন। আমাকে এবং সহকর্মী ফরহাদ আহমেদকে নিয়ে সকালের নাস্তা খেতে এক কিলোমিটার দূরে যেতেন। খাবার পছন্দের ব্যাপারে তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ছিল। অধিকাংশ দিন নাস্তার বিল তিনিই দিতেন। আমরা দেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি রাগ করতেন। মাত্র চার মাসের মধ্যেই আমি বদলি হয়ে চট্টগ্রাম সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে চলে আসলাম। ১৯৯৮ সালের মার্চে ফরহাদ আহমেদ চট্টগ্রামে যোগদান করলেন। তিনি ২০০১ সালের জানুয়ারির ১৯ তারিখ চট্টগ্রাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলেন। আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হলো। ভ্রমণ পিপাসু এই মানুষটি নানান জায়গায় দল নিয়ে বেড়াতে পছন্দ করতেন। তাঁর সহধর্মিণী প্রফেসর মাহমুদা খানমও ভ্রমণে আগ্রহী।
প্রোমোট প্রকল্পের লিয়াজোঁ অফিসার কালাম সাহেব সহ এক বন্ধে দুই পরিবার ও তিন ব্যাচেলর আমি, ফরহাদ এবং মাকাতো হায়াসি (জাপানি নাগরিক, কলেজে বিজ্ঞানাগারে ল্যাব সহকারী পদে ভলেন্টিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন) টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন ও কঙবাজার বেড়িয়ে এলাম। চলতি পথে চকোরিয়ার ডুলহাজরা সাফারি পার্ক, রামুর মন্দির পরিদর্শন ছিল বাড়তি আয়োজন। ২০০২ সালে আয়োজন করলেন এম এড ও বি এড শিক্ষার্থীদের নিয়ে সুন্দরবন ভ্রমণের। রেজাউল করিম স্যার পুরো আয়োজনের ছক তৈরি করলেন। শিক্ষক পরিবার জোবাইদা নাসরিন আপার পরিবার, শুক্লা ইফতেখার আপার পরিবার, রেজাউল করিম স্যারের পরিবার, অধ্যক্ষ মহোদয়ের পরিবার আমি এবং ফরহাদ।
কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলেন উনিশ জানুয়ারি ২০০১। যোগদান করেই কলেজকে সবুজায়নের দায়িত্ব নিলেন। ইউক্লিপ্টাস, বকুল মাঠের চারিদিকে সারিবদ্ধভাবে লাগালেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে ছায়া ঢাকা একটা ক্যাম্পাস পেলাম। দীর্ঘ বছর আমরা উপভোগ করেছি।
শিশুর মতো মনের এই মানুষটি শিশুদের অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। একইভাবে শিশুরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করতেন। আমাদের দুই মেয়ের জন্মদিনে আমৃত্যু শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। স্যারের সব আত্মীয়স্বজনদের বাচ্চাদের সাথে তাঁর সখ্য অনন্তকালের।
ভূগোল বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে ছিলেন আনপ্যারালাল। বিষয়বস্তুর ভেতরে গিয়ে উপকরণ ব্যবহার করে সহজ করে বোঝানোর ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতো বোর্ডে চমৎকারভাবে গ্লোব আঁকা। কর্কটকান্তি, মকর কান্তি রেখাসহ ভরা কটাল, মরা কটাল সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান তাঁকে উঁচু মানের শিক্ষকের মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়াও শিক্ষা মনোবিজ্ঞান, শিশু মনোবিজ্ঞান বিষয়ক পাঠদানেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। কাজ করেছেন শ্রেণি কক্ষের শিক্ষক হিসেবে, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপ–পরিচালক হিসেবে, সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে। সবক্ষেত্রেই তাঁর অবদান স্মরণীয় এবং অনুকরণীয়। চমৎকার কণ্ঠের অধিকারী সবুক্তগীন মাহমুদ স্যার নিয়মিত বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম কেন্দ্রের আলোচক ছিলেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর সবুক্তগীন মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন নিজের লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ গ্রন্থে। এক মাস বয়সে মাকে হারিয়ে চাচি, বাবা, ভাই–বোন ও নিকটাত্মীয়দের আন্তরিক আদরে জীবনযুদ্ধে কীভাবে টিকে আছেন তা সবিস্তারে লিখেছেন ‘ভাগ্যের সিঁড়ি বেয়ে’ বইতে। লিখেছেন বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত জেলা পরিচিতি, বাংলাদেশ ভূগোল, ছোটদের জন্য ভূগোল পরিচিতি, বঙ্গাল থেকে বাংলাদেশ। প্রতিটি বইয়ে আছে স্যারের মেধার সুস্পষ্ট ছাপ।
অফিসিয়াল ড্রাফট, ফাইলিং, হাতের লেখা চিঠি, অফিসিয়াল যোগাযোগ, শিক্ষক, কর্মকর্তা– কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধা প্রদান, কলেজ ক্যাম্পাস সজ্জিতকরণ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থাকরণ। কৃষির প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। তিনি কৃষি কর্মকর্তাদের কলেজে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে কলেজের খালি জায়গাগুলোতে নানান গাছ লাগিয়েছেন। আমাদের শিক্ষার্থী জিয়ার (আলীকদম) আগ্রহে সহকর্মী আবদুল খালেক এর সহযোগিতায় তাঁকে কলেজের পেছনে পেঁপে চাষ করার অনুমতি দিয়েছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক সহায়তাও করেছেন।
শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক শ্রদ্ধেয় শহীদুল আমিন স্যারের সাথে পরামর্শ করে আমাদের (দক্ষতা অনুযায়ী) নানান কাজের দায়িত্ব দিতেন। যেমন– শিক্ষা সফর, কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কারক্রয়। আমরা সানন্দে কাজ করতাম। এর পেছনের কারণটি হলো তৃপ্তি। তিনি নানাভাবে আমাদের কাজের প্রশংসা করতেন। কখনো কখনো পরামর্শ দিতেন আবার কখনো আদর মাখা বকাও দিতেন। আমরা ভীষণ উপভোগ করতাম।
লেখালেখি তাঁর জীবনের সাথে মিশে যাওয়া এক অধ্যায়। যে কয়টি বই তিনি প্রকাশ করেছেন তার সবকয়টি বইয়ের পাণ্ডুলিপি স্যারের নিজের হাতের লেখা। কী চমৎকারভাবে গুছানো, অধ্যায় বিন্যাস, প্রয়োজনীয় ছবি সংযোজন। অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ নিজের আঁকা। প্রতিটি বই একেকটি তথ্য ভাণ্ডার। কলমের প্রতি, কালির বৈচিত্র্যময় আঁচড় তাঁর উদ্যম কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতো। প্রতিটি কলম, কাগজ, পেন্সিল অন্য সবার চেয়ে আলাদা।
ভ্রমণ পিপাসু স্যার দেশের কোনো জেলা বাদ দেননি। পৃথিবীর নানান দেশে, নানান পথে হেঁটেছেন। আমার জানা মতে, সার্কভুক্ত দেশগুলো, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, কানাডা, সৌদি আরবসহ অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। সবকিছুর ভেতর দিয়ে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আমৃত্যু।
আমাদের সাথে মতের অমিল ছিল এক জায়গায়। তা হলো ধূমপান। নানান সময়ে নানা নিষেধ করতাম। কখনো রাগ করতেন আবার কখনো হাসতেন। আমরাও কিনে দিয়েছি তাঁর পছন্দের ব্রান্ডের সিগারেট। হয়তো বলেছি এই শেষ আর দিবো না। আর দিবো না যে কতবার হয়েছে সেই হিসেব লেখা নেই। শেষে এনজিওগ্রাম। রিং বসানো। নিজেই বন্ধ করলেন। শেষ ক‘বছর ধূমপান ছাড়া বেশ ভালোই কেটেছে।
নিজের নামের পূর্বে প্রফেসর লিখতে পছন্দ করতেন না। নামের নিচে অর্জিত শিক্ষার কথা উল্লেখ করতেন না। এমনকি দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও লিখতে চাননি। কারণ জানতে চাইলে বলতেন এগুলো গরিমা বাড়ায়। গরিমা মানুষকে ধ্বংস করে। মাটির সন্তান মাটিতেই মিশে যাবো। আমাদের ক্ষমা করবেন স্যার। আজ আপনার জন্য প্রাণের সমস্ত ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশির সাথে মিশিয়ে দিলাম। পৃথিবীময় হয়ে যাক, বয়ে যাক আকাশে–বাতাসে। বার্তা পৌঁছে যাক আপনার আপন আলয়ে।
তাঁর চলে যাওয়ায় একজন বড় মনের মানুষ চলে গেলেন। চলে গেলেন দেশের প্রথম সারির একজন ভূগোলবিদ। মানুষ জন্মাবে। শিক্ষক হবেন। কিন্তু এমন শিক্ষক সমাজে বিরল। পড়ে আছে স্মৃতির পদ্ম, কদিন পর পর খোঁজ নেয়া, দেশ বিদেশে যেখানেই গেছি তিনি ছিলেন সাথেই। ২০০৪ এ সরকারি একটা প্রশিক্ষণে গেলাম দিল্লি। স্যার উনার ভাতিজা প্রকৌশলী নাসিরউদ্দিন মাহমুদ এর জন্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্য গণি বেকারির বেলা বিস্কুট দিলেন আমার কাছে। আমি এবং জামাল এ নাসের (সাবেক যুগ্মসচিব) স্যার ঠিকানা অনুসারে উনার বাসায় নিয়ে গেলাম। নাসির ভাই দিল্লিস্থ বাংলাদেশের হাই কমিশন এর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন। এমনি নানা ভাবে আমাদের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। এখনো আছেন, থাকবেন আমৃত্যু। ২৪. ০৪. ২৪। কী চমৎকার একটা তারিখ স্মরণীয় হয়ে রইলো স্যারের জন্য। প্রফেসর সবুক্তগীন মাহমুদ স্যার আপনি ভালো থাকবেন। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে স্থান দিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক; শিক্ষক, চট্টগ্রাম সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ।