আমাদের সন্তান- আমাদের প্রত্যাশা

নাছিম আখতার রীনা | সোমবার , ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

পরিবার একটি সমাজিক সংগঠন যার ছত্রছায়ায় একটি শিশুর আগমন। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হয় নিষ্পাপ, অবুঝ, অবোধ প্রাণী হিসাবে। তাকে মানুষের রূপে ফুটিয়ে তুলে পরিবার । তার মধ্যে মানবীয় গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে পরিবারের মাধ্যমে। সে জন্মগত ভাবে সকল গুণাবলী নিয়ে আসলেও তা বিকশিত করার দায়িত্ব পরিবারের। চরিত্র মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ, মুমিনের দাড়িপাল্লায় সব চেয়ে ভারী হল উত্তম চরিত্র। আর পরিবার হল এমন এক সুরক্ষিত দূর্গ যেখানের চরিত্র গঠনের সূচনা হয়।
সাধারণত বলা হয় বাবা পরিবারের প্রধান আর মা পরিবারের প্রাণ। একক পরিবারের জন্য যে কথাটি সত্য যৌথ পরিবারের ক্ষেত্রে সেটা সব সময় সত্য হয়না। ছোট/একক পরিবারে জন্মালে থাকবে বাবা মা ভাইবোন -আর বড়/ যৌথ পরিবারে জন্মালে থাকবে বাবামা ভাই বোন দাদা দাদী চাচা ফুপু অনেকে। প্রথমে মা ও পরে অন্য সকলকে শিশু অনুকরণের মাধ্যমে শিখবে। যত বেশি মানুষের ভিতর একটি শিশু বেড়ে ওঠে তার চরিত্রেও এর প্রতিফলন ঘটে কিছু কিছু। পরিবারেই তার ধর্মীয়, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের সূচনা হবে। সন্তান বাবা মা ছাড়াও আরো অনেকের দ্বারা প্রভাবিত হয়। যেমন শিক্ষক বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশী ।
চরিত্র দু প্রকৃতির হতে পারে সৎ ও অসৎ। তার চরিত্রে সত্যবাদিতা, নিয়ম নিষ্ঠা, বড়দের শ্রদ্ধা করা, পরমতসহিষ্ণুতা বিনয়, ধৈর্য, আত্নীয়তার সম্পর্ক, প্রতিবেশির প্রতি সুসম্পর্ক সকল ভাল চারিত্রিক গুণাবলী জন্মাতে পারে যদি সে পরিবারে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। আর অসৎ গুণাবলী গড়ে ওঠে অসৎ সঙ্গ ও পরিবারের অসাবধানতার জন্য।
প্রত্যেক বাবা মার অপূর্ণ স্বপ্নের বলি হল তার সন্তান। আমি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারি নাই আমার ছেলে/মেয়ে হবে। আমার গাড়ি বাড়ি নাই আমার ছেলে/মেয়ের হবে। আমার সন্তান মানুষের মত মানুষ হবে এ ধারণা খুব কম মানুষের থাকে। সন্তানের চরিত্র নিয়ে চিন্তার সময় কই। সন্তানের চরিত্র গঠনের চেয়ে মুখস্থ করে আত্নকেন্দ্রিক হয়ে -বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করবে সেটাই হবে জীবনের বড় পাওয়া। ফলাফল আমার সন্তানেরা বড় সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার কেউ নাই মৃত্যু শয্যায় পানি দেওয়ার।
সত্যবাদিতা হল চরিত্র গঠনের প্রথম সোপান। আমরা সন্তানের কাছে নিজেও সত্যবাদী নই , নিজের প্রকৃত অবস্থা কোন দিন তাদের বুঝতে দিই না। সত্য লুকাতে শিখাই। নিজের শ্রমে সন্তানকে বিলাসী আয়েসী বানাই। নিজের হাতে ৮০০/ টাকার মোবাইল ছেলের হাতে ৮০০০/ টাকার মোবাইল তুলে দিই, নিজে কষ্ট করবেন সন্তানকে সুখ দিবেন। নিজে না খেয়ে না পরে ভাল পোশাক, খাবার সন্তানের হাতে দিয়েছেন, বলেন নাই সামর্থ নাই, বলেছেন আমি পছন্দ করিনা বা ডাক্তারের মানা। আমার এক সহকর্মী সন্তানের বাসা থেকে বেরিয়ে এসে বাক রুদ্ধ হয়ে যায়। সন্তানের বাসায় তার সমাদর হয়নি, ফিরতি পথে বউমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমার জন্য তোমাদের আর ভাল কোন আপ্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না কেন? তোমরা কি কোন সংকটে আছ? বউমা জানালো উনার ছেলে বলেছে তার বাবা জীবনে ভাল কিছু খেতে চাইতেন না, খেতে পারেননা, কিছু দিয়ে লাভ নাই, খাবেন না। সত্য লুকানোর ফল। ঘরে সবাই একসাথে বসে সমভাবে খেলে এদিন দেখতে হত না। অথচ আমাদের মুরব্বীরা এক ছটাক আঙ্গুর ১০ জনে খেলেও অতৃপ্ত ছিল না।
ছেলের ব্যাগ নিজের কাঁধে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতেন, আপনি জানতেন আপনার কিডনিতে সমস্যা সাবধানে চলাফেরা করতে হবে, সামান্য আছাড় খেয়ে পড়ে আপনি চলে গেলেন দুনিয়া ছেড়ে । আদরের সন্তানকে একা রেখে। তাকে তো জীবনে বোঝা এখন নিজেই টানতে হবে। নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা পরিবার থেকে না শেখায় তার জীবন চলার পথ কঠিন হয়ে গেল।
বড়দের সম্মান করতে আপনি শেখান নাই, আপনি যদি শিখাতেন তবে আপনি অবশ্যই সম্মান পেতেন । ইলেক্ট্রিক বিল বেশি হবে বলে মার রুমের ফ্যানটা রাতে মা ঘুমালে বন্ধ করে দিয়েছেন , মার বয়স হয়েছে বা মার প্রয়োজন আছে তা না বুঝার ভান করলেন। মাকে কমদামী কাপড়টা দিলেন এই ভেবে কোথায় আর যাবে কেউ দেখবেনা। এখন কিভাবে আপনি সেবা বা সম্মান আশা করবেন?
বিনয় উদারতা আমরা শিখতে পারিনা, ভাবি বেশি বিনয়ী হলে- জীবনে কিছু হবে না, সকলের ঘানী টানতে হবে। আমরা ছেলের মেয়েদের নিজের স্বার্থ ঠিক রাখতে শিখিয়েছি- এত বেশি স্বার্থপরতা শিখিয়েছি যে পরবর্তীতে সেটা আমাদের নিকট ফিরে আসে। পাওয়ার প্রত্যাশা বেশি ত্যাগী মনোভাব কম। তাই কম পরিশ্রমে অধিক মুনাফার প্রত্যাশা আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষক কে শ্রদ্ধা, বড়দের প্রতি সম্মান, ভাল ব্যবহার পরিবারে না থাকলে সন্তান তা কখনই শিখবে না। অনেকের ধারণা টাকা দিয়ে শিক্ষা/শিক্ষক কেনা যায় । বন্ধুবান্ধবের সাথে পার্টি করলে বড়লোকের ছেলেমেয়ে বন্ধু হবে। তথা কথিত সমাজে উচ্চ শ্রেণীতে স্থান হবে। চারিত্রিক উন্নতি ঘটবে। বয়স্ক দাদা-দাদী, নানা- নানী বা মুরব্বিদের যত্ন নেয়া, সম্মান দেওয়া, খোঁজ-খবর নেওয়া, সময় দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়, লেখাপড়ার ক্ষতি হবে সময় নষ্ট হবে। এভাবেই আমরা আমাদের অবহেলার পাত্রে পরিণত করেছি।
আমরা এটা শিখাই না- প্রথমে মন দিয়ে শুন পরে বুঝে উত্তর দাও। কিন্তু আমরা আগে নিজের ঢোল নিজে পিটাতে পছন্দ করি, নিজের মতামতকে বড় করে দেখি, পরের ভাষ্য শোনার বা বোঝার সহিষ্ণুতা ধৈর্য, নিজের নাই-তাই সন্তানেরও নাই।
আমরা সন্তানদের অনেক বেশি ভালবাসি।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, রীমা বি এড কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসিআরবিতে হাসপাতাল তৈরির দুঃসাহস সফল হতে দেবো না
পরবর্তী নিবন্ধসিটি কলেজ ছাত্র সংসদের এজিএস তবারক হত্যাকাণ্ড ও কিছু স্মৃতি