আমাদের শ্রম আইনে মালিক এবং শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মালিকের উপর যেমন শ্রমিকের কতিপয় অধিকার রয়েছে তেমনি শ্রমিকের উপরেও মালিকের কিছু অধিকার রয়েছে। এখানে বিষয়টি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ যা একে অপরের অধিকার ও কর্তব্যের সাথে অঙ্গাঙ্গীকভাবে জড়িত। এখানে এ বিষয়ে কিছু ধারনা দেওয়ার চেষ্টা করবো। মালিক শ্রমিকদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারনের নিমিত্তে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ প্রনয়ণ করা হয় ।যা পরবর্তীতে সংশোধন করা হয়। ইতিপূর্বে শ্রমিকের অধিকার নিয়ে লিখেছি। এখন শ্রমিকের দায়িত্ব-কর্তব্য ও মালিকের অধিকার নিয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করবো।
মালিক কে: মালিক বলতে এমন কোন ব্যক্তি যিনি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক নিয়োগ করেন এবং নিম্নলিখিত ব্যক্তিগণও এর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যথাঃ-(ক) উক্ত ব্যক্তির কোন উত্তরাধিকারী, অভিভাবক, হস্তান্তরমূলে উত্তরাধিকারী বা আইনগত প্রতিনিধি, (খ) উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক বা উহার ব্যবস্থাপনা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি, (গ) সরকার কর্তৃক বা সরকারের কর্তৃত্বাধীন পরিচালিত কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, এ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কোন কর্তৃপক্ষ, অথবা এরূপ কোন কর্তৃপক্ষ না থাকলে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের প্রধান, (ঘ) কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বা এর পক্ষে পরিচালিত কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, এ উদ্দেশ্যে নিযুক্ত কোন কর্মকর্তা অথবা এরূপ কোন কর্মকর্তা না থাকলে, এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, (ঙ) অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, এর মালিক এবং উহার প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপক, সচিব, প্রতিনিধি অথবা এর কাজ-কর্মের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোন কর্মকর্তা বা ব্যক্তি, (চ) মালিক ব্যতীত অন্য কোন ব্যক্তির দখলে আছে এরূপ কোন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে, উক্ত প্রতিষ্ঠান দখলকারী ব্যক্তি অথবা উহার নিয়ন্ত্রণকারী চূড়ান্ত ব্যক্তি অথবা ব্যবস্থাপক অথবা উক্ত কাজ-কর্মের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোন উপযুক্ত কর্মকর্তা।
কাজ বন্ধ রাখা: অগ্নিকাণ্ড, আকষ্মিক বিপত্তি, যন্ত্রপাতি বিকল, সরবরাহ বন্ধ, মহামারী, ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা অথবা মালিকের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অন্য কোন কারণে প্রয়োজন হলে, কোন মালিক যে কোন সময় তার প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা শাখাসমূহ আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবেন এবং যে কারণে উক্তরূপ বন্ধের আদেশ দেওয়া হবে তাহা বিদ্যমান থাকা পর্যন্ত এই বন্ধের আদেশ বহাল রাখতে পারবেন।
প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা: কোন প্রতিষ্ঠানের কোন শাখা বা বিভাগে বে-আইনী ধর্মঘটের কারণে মালিক উক্ত শাখা বা প্রতিষ্ঠান আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবেন, এবং এরূপ বন্ধের ক্ষেত্রে ধর্মঘটে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকগণ কোন মজুরী পাবে না।
ছাঁটাই: শ্রম আইনের ২০ ধারা মতে কোন শ্রমিককে প্রয়োজন অতিরিক্ততার কারণে কোন প্রতিষ্ঠান হতে ছাঁটাই করা যাবে।
চাকরি থেকে ডিসচার্জ: শ্রম আইনের ২২ ধারা মতে কোন শ্রমিককে, কোন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক প্রত্যয়িত, শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা বা অব্যাহত ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে চাকরি হতে ডিসচার্জ করা যাবে ।
মজুরি কর্তন: মজুরি কর্তনের বিষয়ে শ্রম আইনের ১২৫ থেকে ১৩০ ধারা পর্যন্ত কিছু শর্তসাপেক্ষে মজুরি কর্তনের বিধি বিধান আলোচনা করা হয়েছে। যেমন- কর্তব্য কাজে অননুমোদিত অনুপস্থিতির জন্য কর্তন, কোন শ্রমিকের হেফাজতে প্রদত্ত মালিকের কোন মালামালের ক্ষতি বা লোকসান, অথবা তিনি যে অর্থের জন্য হিসাব দিতে দায়ী সে অর্থ বিনষ্টের জন্য কর্তন,যদি উক্তরূপ ক্ষতি বা বিনষ্টের জন্য সরাসরি তার অবহেলা বা গাফিলতি দায়ী হয়, মালিক কর্তৃক সরবরাহকৃত বাসস্থানের জন্য কর্তন,কোন অগ্রিম বা কর্জ আদায়ের জন্য কর্তন, অথবা কোন অতিরিক্ত মজুরী প্রদানের ক্ষেত্রে উহা সমন্বয়ের জন্য কর্তন, শ্রমিক কর্তৃক প্রদেয় আয়কর বাবদ কর্তন, কোন আদালতের আদেশে কর্তন, অথবা উক্তরূপ কর্তনের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন কোন কর্তৃপক্ষের আদেশে কর্তন ইত্যাদি।
মালিকের ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতি: শ্রম আইনের ১৭৬(খ) ধারা মতে মালিক এবং শ্রমিকের সম্পর্ক, অথবা মালিক এবং মালিকের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে কোন পার্থক্য ছাড়াই সকল মালিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র সাপেক্ষে তাহাদের নিজস্ব পছন্দের ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার থাকবে ।
শ্রমিকের পক্ষে অসৎ শ্রম আচরণ: মালিকের বিনা অনুমতিতে কোন শ্রমিক তার কর্মসময়ে কোন ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকান্ডে নিয়োজিত থাকবেন না, কোন শ্রমিক বা শ্রমিকগণের ট্রেড ইউনিয়ন অথবা ইউনিয়নের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি-কোন শ্রমিককে কোন ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়ার জন্য অথবা না হওয়ার জন্য অথবা উক্ত পদে বহাল থাকার জন্য অথবা তা হতে বিরত থাকার জন্য ভীতি প্রদর্শন করবেন না, কোন শ্রমিককে বা অন্য কোন ব্যক্তিকে কোন সুযোগ দিয়ে বা সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করে অথবা তার জন্য সুযোগ সংগ্রহ করে অথবা সংগ্রহ করার প্রস্তাব দিয়ে তাকে কোন ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হতে বিরত রাখার জন্য অথবা উক্ত পদ ছেড়ে দেয়ার জন্য প্রলুব্ধ করবেন না, ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ, চাপ প্রয়োগ, হুমকি প্রদর্শন, কোন স্থানে আটক, শারীরিক আঘাত, পানি, শক্তি বা টেলিফোন সুবিধা বিচ্ছিন্ন করে অথবা অন্য কোন পন্থা অবলম্বন করে কোন শ্রমিককে কোন ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলে চাঁদা প্রদান করার জন্য বা না করার জন্য বাধ্য করবেন না বা বাধ্য করার চেষ্টা করবেন না।
চেক অফ: ২০৪ ধারা মতে অনুরোধ করলে যে কোন মালিক তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকগণের, যারা ঐ সিবিএ ইউনিয়নের সদস্য, মজুরী হতে সিবিএ ইউনিয়নের তহবিলে দেয় তাহাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা, ঐ সিবিএ ইউনিয়ন কর্তৃক পেশকৃত ডিমান্ড স্টেটমেন্ট এর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি শ্রমিকের অনুমোদন সাপেক্ষে, কেটে আলাদা করে রাখবেন,তবে শর্ত থাকে যে, সিবিএ বহির্ভূত ইউনিয়নের সদস্যরা রসিদের মাধ্যমে চাঁদা প্রদান করতে পারবেন।
ধর্মঘট ও লক-আউট: যদি কোন ধর্মঘট বা লক-আউট শুরু হয়ে যায়, তাহলে বিরোধটি নিষ্পত্তির জন্য বিরোধে জড়িত যে কোন পক্ষ শ্রম আদালতে দরখাস্ত পেশ করতে পারবে।
বেআইনী ধর্মঘট বা লক-আউটের দণ্ড: শ্রম আইনের ২৯৪ (১) ধারা কোন শ্রমিক কোন বেআইনী ধর্মঘট শুরু করলে, অথবা চালিয়ে গেলে, অথবা তা এগিয়ে নেওয়ার জন্য কোন কাজ করলে, তিনি ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। শ্রমিকগণের সাধারণ অপরাধের দণ্ড: শ্রম আইনের ৩০৫ ধারা মতে এই আইনের অন্য বিধানাবলী সাপেক্ষে, কোন প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কোন শ্রমিক তার উপর দায়িত্ব বা কর্তব্য আরোপকারী কোন আইন বা কোন বিধি, প্রবিধান বা স্কীম বা কোন বিধিসম্মত আদেশের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে, তিনি পাঁচশত টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
কখন শ্রম আইন প্রযোজ্য নয়ঃ শ্রম আইনের ১(ঘ) ধারা অনুযায়ী জনহিতকর, ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে স্থাপিত প্রতিষ্ঠান সমূহে যা মুনাফা বা লাভের লক্ষে প্রতিষ্ঠিত বা পরিচালিত না। এমন কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের উপর শ্রম আইন, ২০০৬ প্রযোজ্য হবে না।
শ্রমিকগণের দায়িত্ব : শ্রম আইনের ৩৩১ ধারায় শ্রমিকের দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে । কোন প্রতিষ্ঠানে কোন শ্রমিক- (ক) এতে শ্রমিকগণের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত কোন ব্যবস্থার বা স্থাপিত কোন যন্ত্রপাতির ইচ্ছাকৃতভাবে অপব্যবহার বা এর ব্যবহারে হস্তক্ষেপ করবেন না; (খ) ইচ্ছাকৃতভাবে বা যুক্তি সংগত কারণ ব্যতিরেকে এমন কোন কিছু করবেন না যাতে তার বা অন্য কোন ব্যক্তির বিপদ হতে পারে; (গ) এতে শ্রমিকগণের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য স্থাপিত কোন যন্ত্রপাতি বা ব্যবস্থা ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহারে গাফিলতি করবেন না। মালিকগণ শ্রম আইনের বিধানমতে নানা অধিকার ও ক্ষমতা ভোগ করেন । তবে তা উক্ত আইনের বিধানমতে কার্যকর করতে হবে। মালিক শ্রমিক সুসম্পর্ক জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। এজন্য একে অপরের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : প্রবন্ধকার, আইনজীবী, কলামিস্ট