আমাদের শিশু – পথশিশু

জামাল উদ্দিন বাবুল | বৃহস্পতিবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:৫৭ পূর্বাহ্ণ

পথ শিশু বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো পারিবারিক বন্ধন হতে বিচ্ছিন্ন বিতাড়িত সেই সব শিশু যারা বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে রাস্তার ধারে, ফুটপাতে, রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে, বাস টার্মিনালে ও লঞ্চ টার্মিনালে বেঁচে থাকার জন্য জীবন যুদ্ধে সামিল হয়েছে তারা। চট্টগ্রাম শহরের বেশ কিছু এলাকা জুড়ে এসব পথশিশুদের অবাধ বিচরণ দৃশ্যমান। এদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে বিচিত্র সব কাহিনি। পারিবারিক কলহ, দ্বন্দ্ব, পিতা মাতার বিচ্ছেদ, দারিদ্র্যতা এসব ছাড়াও রয়েছে পিতার মৃত্যুর পর মা অন্য কাউকে বিয়ে করে সন্তানকে পরিত্যাগ করে চলে যায়, আবার মাকে তালাক দিয়ে পিতা নুতন বিয়ে করে সন্তানকে অবজ্ঞা, অবহেলা করে, সৎ মায়ের হাতে শারীরিক নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেক শিশু বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। অনেক সময় কিছু কিছু মহিলা মারা গেলে শিশুরা অসহায় হয়ে পড়ে। পিতার কাছে পিতার নূতন বিয়ে করা বৌয়ের কাছে এরা বোঝা হয়ে যায়। অযত্ন, অনাদর অবহেলা, বঞ্চনা, অন্যায়ভাবে নির্যাতন ইত্যাদি কারণে কিছু কিছু শিশু গৃহত্যাগ করে পথ শিশুর তালিকায় সংযুক্ত হয়। পথ শিশুদের শতভাগ দারিদ্র্য পীড়িত পরিবার থেকে আগত। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের যে সব পরিবার দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে, দুবেলা দুমুঠো অন্ন যোগাতে সেখানে ত্রাহি অবস্থা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পথশিশু দেখা যায় রাজধানী ঢাকায় আর কম রয়েছে সিলেটে। এছাড়া ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, কুমিল্লা , বরিশাল এসব জেলাতেও শত শত পথশিশুর বিচরণ দেখা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোর এক জরীপে প্রদত্ত তথ্য জানা যায় এদের ৮২% শতাংশ ছেলে ও ১৮% শতাংশ মেয়ে শিশু। ৩৮ ভাগ শিশু ঘর ছেড়েছে পেটের দায়ে। ৭০ ভাগ শিশু লিখতে পড়তে জানে না। অন্যদের কেউ কেউ ২য় শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া লেখা করেছে। প্রতি ১০ জনের ৭জন জীবন মানের উন্নয়ন ও শিক্ষা নিতে আগ্রহী। খুবই করুণ ও নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি এসব পথশিশুদের জীবন। খাবারের সমস্যা তো নিত্যদিনের। পরিধেয় কাপড় নেই, অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখার কেউ নেই। রাতের বেলা ঘুমানোর স্থান সংকটসহ নানা সমস্যার মধ্যে এরা দিন যাপন করে। শীতকালে কাঁথা কম্বল ও শীত বস্ত্র ছাড়া ঘুমাতে গেলে এদের কষ্টের সীমা থাকে না। স্টেশনের প্লাটফর্মে যে সব শিশুরা থাকে তাদের কেউ কেউ যাত্রীদের মালামাল বহন করে, বোতল কুড়ায়, আবার কেউ কেউ ভিক্ষা করে যা পায় তা দিয়ে কোনো কোনো সময় একবেলা খাবারের সংস্থান করতে পারলেও প্রায় সময় অভুক্ত থাকে। ছিন্নমূল এসব শিশুদের বয়স আনুমানিক ৭ থেকে ১৫ বছরের মত হবে। বাজে সঙ্গীদের পাল্লায় পড়ে এদের কেউ কেউ অপরাধ জগতে পা বাড়ায়। মাদক সেবন, ধূমপান, ছিঁচকে চুরি, ছিনতাই ও অনৈতিক কাজে জড়িয়ে অপরাধী হয়ে উঠে। বদ লোকের খপ্পরে পড়ে দালালের মাধ্যমে কোনো কোনো মেয়ে শিশুকে নিষিদ্ধ পল্লীতে চালান দেয়া হয়। ৯৬% ভাগ শিশু কাজ করতে গিয়ে নানা ভাবে হেনস্থার শিকার হয়। এছাড়া ৭৬ ভাগ শিশু মানসিক নির্যাতনে দারুণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। কোনো কোনো পথ শিশু ভাঙ্গারী কুড়ায়, কেউ কেউ যাত্রীদের মালামাল বহন করতে গিয়ে স্টেশনের কুলিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। মানুষের তির্যক চাহনী ও মন্দ বাক্যের আঘাতে এসব শিশুদের মনের কী অবস্থা দাঁড়ায় তা একমাত্র তারাই জানে। বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা আইনে এসব অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব সরকারের। বেসরকারি কিছু কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পথশিশুদের জন্য কাজ করছে। পাশাপাশি সুশীল সমাজ সহ বিত্তশালীদের এদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়া দরকার। ২০১০ সালে ঘোষিত বাংলাদেশের খসড়া জাতীয় শিশুনীতি অনুসারে ১৮ বছরের কম বয়সের ছেলে মেয়েরা শিশু বলে স্বীকৃত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫% ভাগ শিশু। এদের মধ্যে সুবিধা বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা প্রায় ২০ ভাগ। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশে তিন শ্রেণির শিশুর অস্তিত্ব দেখা যায়। প্রথমত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশু, এরা খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদন সহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির মধ্যে পড়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশু। এসব শিশু সার্বিক সুযোগ সুবিধা থেকে আংশিকভাবে বঞ্চিত। প্রাথমিক ভাবে এসব শিশু শিক্ষা লাভের সুযোগ পেলেও আর্থিক অসচ্ছলতা, দারিদ্র্যতা ও নানা টানাপোড়েনর কারণে বেশিদূর যেতে পারে না। তৃতীয় শ্রেণির যেসব শিশুরা রয়েছে তারা হলো ছিন্নমূল, অভিভাবকহীন। এদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই, ক্ষুধার্ত এসব শিশু অনাহারে অর্ধাহারে পুষ্টিহীনতায় রোগে শোকে কাহিল। এরাই পথশিশু ও ঠোকাই উপাধিপ্রাপ্ত। সামাজিক সুরক্ষা আইনে পথশিশুদের জীবন মান উন্নয়নে এবং নিরাপদ একটি আবাসন গড়ে যদি এসব শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেয়া যায় তা হবে মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে যে কটি শিশু নিবাস রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এর সংখ্যা বাড়ানোর দরকার যেহেতু জনসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ছিন্নমূল এসব শিশুদের হারও বাড়ছে। আশার কথা ঢাকা সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু কিছু সংগঠন পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। পথশিশুরা আমাদের সমাজের একটি অংশ। এরাও আদর স্নেহ ভালোবাসা ও মায়া মমতা পাওয়ার ও ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বিনীত নিবেদন সমাজের অবহেলিত এসব শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল নির্ধারণ করে এদের শিক্ষা দান সহ সমাজে আর দশটা শিশুর মত বেড়ে উঠার সুযোগ সৃষ্টি করা হোক যাতে তারা একদিন মানুষের মত মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে দাঁড়াতে পারে। দূর হয়ে যাক এদের জীবন থেকে সকল গ্লানি, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা ও বঞ্চনা।

লেখক: সভাপতি, নবীন মেলা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআয়না
পরবর্তী নিবন্ধতাসাওউফ, খোদাপ্রেম, সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং বিশ্বঅলি সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (ক.)