বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পিছনে আছে এক গৌরবময় ইতিহাস। সে ইতিহাস বিশাল এক আত্মত্যাগের। এই আত্মত্যাগের ইতিহাস আমাদের বিশ্বে বাঙালি হিসাবে অনন্য গৌরবে অভিষিক্ত করেছে। আমাদের এই গৌরবময় ইতিহাস জানতে শুধু পাঠ্যবই নয়, এর বাইরেও আমাদের প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। যে ইতিহাস আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু হয়তো আমাদের দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে গেছে। এজন্য প্রকৃত ইতিহাস জানতে হলে ইতিহাসে শিকড়ে প্রবেশ করতে হবে, চর্চা করতে হবে এবং সেটা ধারণ ও লালন করতে হবে। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগে নানা ধরনের মানুষের যে অবদান ও বহুমাত্রিক দিক রয়েছে তা একটি নিরন্তর গবেষণার বিষয়। এই নানা অবদানের বিষয়গুলোকে সামনে তুলে এনে যতই আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে দিতে পারবো ততই বিশ্বে আমরা জাতি হিসেবে উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা পাব। মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস আমরা জানি সেখানে পুরুষদের যে ভূমিকা উজ্জ্বলভাবে আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়, নারীদের হয়তো সেভাবে হয় না। কিন্তু নির্মোহ দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো মুক্তিযুদ্ধে নারীদের আত্মত্যাগ ও অবদান বিশাল, কিন্তু সেভাবে উজ্জ্বলভাবে বিষয়টি আমাদের সামনে আসে না। দু’লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের কথা আমরা সবাই বলি, এটি নারীদের আত্মত্যাগের উজ্জ্বলতম একটি দিক। তাছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে কত নারী আহত নিহত হবার পাশাপাশি আরো কতভাবে যে নারীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর দেশের সর্বত্র সাধারণ জনগণই স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাথমিক প্রতিরাধ গড়ে তোলে। এখানে কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার নিজ নিজ কাজ ফেলে সবাই সর্বশক্তি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণের ফলে এই যুদ্ধ এক পর্যায়ে জনযুদ্ধে রূপ লাভ করেছিল এবং এতে নারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। এ নিয়ে নানা গবেষণায় নারীদের অংশগ্রহণের তথ্য আমাদের দৃশ্যমান হয়। নারীদের এ অংশগ্রহণ ছিল বহুমুখী। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা সমানতালে আন্তরিকতা, সাহসিকতা, বিচক্ষণতা, শ্রম, মেধা–মননশীলতা, সৃজনশীলতা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধচলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য–সহযোগিতা, সেবা–চিকিৎসা, ওষুধপত্র, খাবার, প্রয়োজনীয় অর্থ, গোপন তথ্য আদান–প্রদান, অস্ত্র বহন, অস্ত্র চালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে লুকিয়ে রেখে, প্রয়োজনীয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে, সরাসরি যুদ্ধে গিয়ে নারীরা এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছেন। এজন্য যুদ্ধকালীন, যুদ্ধ–পরবর্তী সময়ে নারী সমাজকে অনেক বঞ্চনা, নিপীড়ন, অপমান, দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি পেতেও অনেক অপেক্ষার প্রহর গুণতে হয়েছে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শে, সাহস ও উৎসাহ প্রদানে ভূমিকা রেখেছেন মহীয়সী নারীরা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চিত্রই বলে দেয় মুক্তিযুদ্ধে কত মা হারিয়েছেন তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধন, স্ত্রী হারিয়েছেন তাঁর স্বামী, বোন হারিয়েছেন তাঁর ভাইকে। সংসারহারা, ভিটেছাড়া হতে হয়েছে অজস্র নারীকে। অনেকে পরিবারের পুরুষ প্রধানরা যখন যুদ্ধের মাঠে সে সময় কত নারীকে পরিবারের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হয়েছে এবং এ মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেনি এমন পরিবারের যুদ্ধপরবর্তী দায়িত্ব নিয়ে সংসার সামলিয়েছেন সে খবর কতজনেই রাখি? তাঁদের এ অবদান কোনোদিন ভুলবার নয়। মুক্তিযুদ্ধে নারীরা যে সাহস, কৃতিত্ব ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন তা ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং এ অবদানকে খাটো করে দেখা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুধু অস্ত্র হাতে নয় নারীদের নানা অবদান আমাদের বিস্মিত করে। মুক্তিযুদ্ধে অনেক নারীকে দেখা গেছে সংগ্রামের অগ্রভাগে। বিভিন্ন ধরনের সমাবেশ, মিছিল মিটিং ও সেমিনারের তাঁদের অংশগ্রহণ সকলকে উজ্জীবিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক গানে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখ করার মত। যুদ্ধের সময় তথ্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিয়ে অনেক নারী যুদ্ধের পরিকল্পনা করতে সহায়তা করেছিলেন। এছাড়া দেশে ও দেশের বাইরে জনমত গঠন, যুদ্ধকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্না, খাদ্য সংগ্রহ ও অস্ত্র সরবরাহকারিণী হিসেবে নারীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। নিজের জীবন বিপন্ন করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের শোবার ঘরে, বাথরুমে, গোসলখানায় লুকিয়ে রাখার মত ঘটনাগুলো নিছক কোনো কল্পকাহিনি নয়। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান, নিজের কাছের নিকটজনকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে অনুপ্রেরণা দানের মত ঘটনা আমাদের অনেকেরই জানা। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনেক নারী গান, কবিতা, নাটক, সংবাদ পাঠ, কথিকাসহ নানামুখী যে প্রচারণায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন তা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। যুদ্ধ চলাকালীন সময় মুক্তিযুদ্ধের জন্য তহবিল গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য তহবিল সংগ্রহেও বড় ভূমিকা রাখেন। আরো কতভাবে যে নারীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তা নানাজনের গবেষণায় ক্রমাগত উঠে আসছে। আমাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নির্মিত অনেক চলচ্চিত্র বা নাটকে নারীদের এ বীরত্বগাথা কাহিনি গল্পের আদলে আমাদের সামনে দৃশ্যমান হয়। মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য সেতারা বেগম ও তারামন বিবি ‘বীর প্রতীক’ খেতাবপ্রাপ্ত নারী। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের উজ্জ্বল প্রতিনিধি। মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি সহযোদ্ধা হিসেবে নারীর আত্মত্যাগ, সাহস, নির্ভীকতা বাংলাদেশে স্বাধীনতার ইতিহাসে অবশ্যই অবিস্মরণীয়। নারীরা শুধু অস্ত্র হাতে নয়, অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের স্নেহ–মমতার বন্ধনে যেভাবে আগলে রেখেছেন তা স্বীকার করতেই হবে। নারীরা নিজের প্রাণ–আর ইজ্জতের বিনিময়ে তো বটেই– যুদ্ধে নারীর আরো যে বহুমাত্রিক অবদান আমাদের সামনে আসে তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, ইছাপুর বিএমসি কলেজ।