আমাদের বিজয় আমাদের অর্জন

‘খণ্ড খণ্ড এই সব চিত্রই আমাদের বিজয়ের অখণ্ড মোজাইক’

মেজর মোঃ এমদাদুল ইসলাম (অব.) | মঙ্গলবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

একটি জাতি নানা ধরনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সে অবস্থানে তার অবস্থা বিবেচনায় সাধারণত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করে। এর মাঝে হতে পারে বিমাতাসুলভ আচরণ, শোষণ বঞ্চনা, নিপীড়ন নির্যাতন, অবহেলা বৈষম্যমূলক আচরণ ইত্যাদি। এই সব আচরণের শিকার থেকে উৎসারিত ক্ষোভ একটি জাতিকে তার স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তা অর্জনে নিশ্চিতভাবে ধাবিত করে এবং সে অর্জন আয়োজনে জীবন উৎসর্গে অনুপ্রাণিত তথা প্রত্যয়ী করে। কবি সৈয়দ শামসুল হক’এর কবিতা ‘আমার পরিচয়’ এ তিনি তথা বাঙালী জাতির পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, আমি ত এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলি থেকে, সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে, কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে, পাল যুগের চিত্রকলা থেকে, পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার থেকে, জোড়বাংলার মন্দির বেদী থেকে, বরেন্দ্রভূমের সোনা মসজিদ থেকে, আউল বাউল মাটির দেউল থেকে, সার্বভৌম বার ভূঁইয়া থেকে, তিতুমির আর হাজি শরীয়ত থেকে, গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণা থেকে। এরও পূর্বে বিদ্রোহী কবি নজরুল সদর্পে ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাউকে কুর্ণিশ’ বিপ্লবের কবি সুকান্ত সদর্পে উচ্চকিত হয়েছিলেন

সাবাশ বাংলাদেশ অবাক পৃথিবী তাকিয়ে রয়,

জ্বলে পুড়ে ছারকার তবু মাথা নোয়াবার নয়’।

এমন এক মানস আর মননে বাঙালি জাতিসত্তা ক্রমাগত ঋদ্ধ হয়। এ থেকেই ১৯৭১ বাঙালি জাতি দাঁড়িয়ে যায় ইতিহাসের মুখোমুখি। ১৯৭১ হয়ে যায় বাঙালির দ্রোহের কাল। এ দ্রোহকে বিদ্রোহে পরিণত করে হাজার বছরের রাষ্ট্র কাঠমোর অভিধাবিহীন শতধা বিভক্ত বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে, তাকে আপোষহীন পথ চলতে, উজ্জীবিত করতে চারণ কবির মত একজন নেতা শেখ মুজিব তার ঐক্যের একতারা হাতে ঘুরে বেড়িয়েছেন শ্যামল বাংলার পথে প্রান্তরে। যার ফলশ্রুতি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের বিজয়ের গৌরবান্বিত দিন। এই বিজয় অর্জনে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস একটি ব্যাপক রক্তাক্ত সংগ্রামে ত্রিশ লক্ষ জীবন এবং দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভম বিসর্জন দিতে হয়েছে। এর বাইরেও মুক্তিযুদ্ধের শুরুর পূর্বে এর পটভূমি রচনায় এবং মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে খণ্ড খণ্ড ঘটনাবলী জনান্তিকে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে, আমাদের ইতিহাসের পাতাকে বর্ণিল করেছে। সেরকম কিছু ঘটনার বর্ণনা এ লেখায়।

পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলী, ডি এম ও হিসাবে তৎকালীন কর্নেল ওসমানী’র কাছ থেকে দায়িত্বভার গ্রহণ সংক্রান্ত ঘটনা (পরবর্তীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিনায়ক এবং জেনারেল) তার বই How pakistan Got Divided এর ১৩ পৃষ্ঠায় তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘ডি এম ও হিসাবে দায়িত্ব বুঝে নিতে গিয়ে আমি রীতিমত স্তম্বিত হয়ে গেলাম। একথা জেনে যে, তাকে কোন ফাইলই দেখতে দেওয়া হয়না, এমনকি চাপরাশিরা পর্যন্ত তাকে অবজ্ঞা করে চলে। তার অফিস ঝাড়ু দেওয়া হয় না, অফিসটি নিস্ক্রিয়, ক্ষমতাহীন, অকার্যকর এবং সর্ব্বোতভাবে উপেক্ষিত”। এই ছিল সামরিক পরিমণ্ডলে বাঙালিদের প্রতি আচরণ।

জেনারেল আমিন আহম্মেদ চৌধুরী তার বই ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন’ এর ৬৯ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেছেন। ১০ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যা। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে অবস্থানরত সৈন্যদের পরিদর্শনে আসেন। সেখানে ক্যাপ্টেন আমিন আহাম্মেদ চৌধুরীও উপস্থিত। পরিদর্শন শেষে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ক্যাপ্টেন আমিন আহাম্মেদকে একপাশে ডেকে নিয়ে চুপিসারি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর অচল করে দিতে হবে, এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বড় সমুদ্রগামী কোস্টার আছে, রাতে তুমি জনাব সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় গিয়ে উনার কোস্টার ডুবানোর সম্মতি নিয়ে আসবে’। সেই আদেশ অনুযায়ী রাত এগারটায় ক্যাপ্টেন আমিন আহাম্মেদ চৌধুরী আমবাগানে এম আর সিদ্দিকী সাহেবের বাসায় পৌঁছে যান। সাক্ষাতে আমিন আহাম্মেদ চৌধুরীর প্রস্তাবে সামান্যতম দ্বিরুক্তি না করে এম আর সিদ্দিকী সাহেব তার সম্মতি প্রদান করেন। সম্মতি সূচক মন্তব্যে এম আর সিদ্দিকী সাহেব সে রাতে বলেছিলেন ‘দেশের স্বাধীনতার জন্য আমার সামান্য একটি কোস্টার কোন কিছুই না’।

শারমিন আহামদ তার বই, তাজউদ্দীন আহামদ নেতা ও পিতা’র ২৭৯ পৃষ্ঠায়, বঙ্গবন্ধুর পার্সোনাল এইড হাজী গোলাম মুর্শিদের বয়ানে বর্ণনা করেছেন রাত “বারোটা প্রায় বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল। টেলিফোনকারী বলেন “ আমি বলধা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কি করব?” আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম, বললাম ফোন এসেছে “মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কি করব? উনি বললেন ‘মেশিনটা ভেঙ্গে ফেলে পালিয়ে যেতে বল। যাকে সে রাতে পালিয়ে যেতে বলা হয় তিনি প্রকৌশলী এ,কে,এম নুরুল হক, পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরির্বতনের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে তমঘা এ ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করেছিলেন। এই মেধাবী দেশপ্রেমিক প্রকৌশলী খুলনায় বসে ট্রান্সমিটার তৈরী করে ঢাকায় এনে বলধা গার্ডেন থেকে সেই রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়েছিলেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী প্রকৌশলী এ.কে.এম নুরুল হক কে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়, তিনি আর কখনো ফিরে আসেননি।

ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ সায়গল, বাবা মেজর আবদুল মজিদ সায়গল মা বগুড়ার নবাব পরিবারের মেয়ে। মেজর আবদুল মজিদ সায়গল ১৯৫৬৫৮ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। মেজর আবদুল মজিদ সায়গল এর অধীনে জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ (পরবর্তীতে উভয়েই বীর উত্তম এবং সেনাপ্রধান) কর্মরত ছিলেন। ইকরামুল মজিদ সায়গল ১৯৬৫ সালে ৩৪ পিএমএ’ র ক্যাডেট হিসাবে কমিশন পেয়ে বাবার ইউনিট দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’এ যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকায় অবস্থানরত ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ সায়গল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পালিয়ে নরসিংদিতে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’এ হাজির হন। তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সফল অভিযানেও অংশগ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্য দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’এর তারা বেশি দিন ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ সায়গলকে আস্থা এবং নিরাপত্তায় ধরে রাখতে পারেনি। ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ সায়গলকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আগরতলা বন্দী শিবির থেকে ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ একসময় পালিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন এবং এখানে তার কোর্ট মার্শাল হয়।

জোয়ান বায়েজ আমেরিকান সঙ্গীত শিল্পী। যুদ্ধ এবং অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ। ১৯৭১ সালে ‘স্টোরি অব বাংলাদেশ’ নাম দিয়ে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কনসার্ট আয়োজন করেন। লক্ষ শ্রোতার সামনে বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে জোয়ান বায়েজ’এর কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ হয়ে ঝরে পড়ে

When the sun sinks in the west

Die a million People of the Bangladesh

অর্থাৎ পশ্চিমে যখন সূর্য অস্ত যায়

তখন বাংলাদেশে লক্ষ মানুষের জানাজা হয়।

আন্দ্রে মারলো, ফরাসী সাহিত্যিক, রেনেসাঁর অগ্রদূত তার কথাই বা আমরা ভুলি কী করে। তিনি তো আমাদের স্বাধীনতার পক্ষ নিয়ে বিশ্ব জনমত গড়ে তুলেছিলেন।

ফ্‌্রান্সের অর্লি বিমান বন্দর। ১৯৭১ এর কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইন্সের বিশাল বোয়িং রানওয়েতে দাঁড়ানো। যাত্রী প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। বিমানবালাদের সুমিষ্ট কন্ঠে নানা নিরাপত্তা নির্দেশিকা সংক্রান্ত ঘোষণা চলছে। বিমানটি উড্ডয়নের জন্য ক্রমাগত রানওয়েতে এগুচ্ছে। উড্ডয়নপূর্ব শক্তি সঞ্চয়ে ককপিটে পাইলট নানা সূইচ চাপাচাপিতে নিবিষ্ট। ইঞ্জিনের প্রচণ্ড গর্জন বিস্তার লাভ করে যাত্রীদের মাঝেও অনুভূত হচ্ছে।

ঠিক উড্ডয়ন মুহূর্তে ঝড়ের গতিতে ফরাসী এক যুবক বিমানের ককপিটে ঢুকে পড়ে। যুবকের উদ্দত হাতে পিস্তল অন্যহাতে ব্রিফকেস। উত্তেজিত কণ্ঠে যুবকটি ঘোষণা করে সে বিমানটি হাইজ্যাক করেছে। বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সেই যুবক।

হাইজ্যাকের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিমান বন্দরের সতর্ক নিরাপত্তা প্রহরীরা এবং ক্রমান্বয়ে সামরিক কমান্ডোরা বিমানটি ঘিরে অবস্থান নেয়। ফরাসী প্রেসিডেন্টের অর্লি বিমান বন্দরে আসার এবং গন্তব্যে উড়াল দেওয়ার কথা ছিল, সে কর্মসূচী বাতিল করা হয়।

গণমাধ্যমে বিমান হাইজ্যাকের খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকলে বিশ্বব্যাপী মানুষের উৎসুক্য বাড়তে থাকে। প্যারিসের নাগরিকদের অনেকেই সেই উৎসুক্যের প্রাবল্যে বিমান বন্দরের আশেপাশে ভিড় করতে থাকেন। এরই মধ্যে আলাপ আলোচনা এবং আপোষের দায়িত্ব নিয়ে একটি দল হাইজ্যাকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। তারা হাইজ্যাকারের চাওয়া কি জানতে চান। আলোচনাকারীরা হাইজ্যাকারের দাবীর কথা শুনে হতভম্ব। তার দাবী যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দুর্গত মানুষের জন্য ২০ (বিশ) টন ঔষধ পাঠাতে হবে। স্তম্ভিত বিশ্ব। এমনও কি দাবী হয়।

কর্তৃপক্ষ সে দাবী পূরণে সম্মত হয়। তখনই ঔষধের চালান নিয়ে আসতে হাইজ্যাকার চাপ সৃষ্টি করে। ঔষধের চালান আসতে থাকে একের পর এক কার্টন। ঐসব কার্টন বিমানে তোলা হতে থাকে। হাইজ্যাকার ককপিটের জানালা দিয়ে বিমানে ঔষধ উঠানোর দৃশ্য দেখে। ঐ দেখায় তার মানবিক মন আর দৃষ্টি একটি জিনিস দেখতে ব্যর্থ হয়। কার্টন বহন কারীরা সবাই ফরাসী সামরিক বাহিনীর কমান্ডো ইউনিটের সদস্য। সুযোগ বুঝে তারা হাইজ্যাকার যুবককে কাবু করে ফেলে। হাইজ্যাকার গ্রেফতার হন। এমন মানবিক মানুষকে গ্রেফতার! ফ্রান্স সহ পৃথিবীর মননশীল মানুষেরা এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান। ফরাসী কর্তৃপক্ষ হাইজ্যাকারের দাবী অনুযায়ী ঔষধ পৌঁছে দেয় বাংলাদেশের যুদ্ধ পীড়িত মানুষের জন্য। ফরাসী সন্ত্রাস বিরোধী আইনে সেই যুবকের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। দু বছর কারাভোগের পর জন দাবীর মুখে যুবকটিকে মুক্তি দেওয়া হয়। এক সামরিক কর্মকর্তার ছেলে এই যুবকের নাম জ্যঁ ইউজিন পল ক্যুয়ে।

আমাদের বিজয় অর্জনে এমনই অনেক ছোট ছোট ঘটনা জাতি হিসাবে আমাদের ঋণী করেছে, আমাদের বিজয়কে স্মরণীয় বর্ণিল করেছে। দুঃখ বেদনার এইসব অভিজ্ঞান যদিও আমাদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় রক্ত ঝরায় তবুও খণ্ড খণ্ড এই সব চিত্রই আমাদের বিজয়ের অখণ্ড মোজাইক। জনান্তিকের এসব ঘটনা সমূহ আমাদের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যত বেশি বিধৃত হবে আমাদের ইতিহাস তত বেশি সমৃদ্ধ হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের দীপ্ত দিনে স্বাধীনতার নতুন উচ্চারণ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ সুবিধা আমাদেরকেই নিশ্চিত করতে হবে