আমাদের বাতিওয়ালা

মোহছেনা ঝর্ণা | সোমবার , ১ জুলাই, ২০২৪ at ১০:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদী পত্রিকায় কোনো লেখা ছাপা হলে ইদানীং আমি একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। কখনো অবশ্য আমার অপেক্ষার আগেই ফোনটা চলে আসে। সেদিনও এসেছে একটু বেলা করে। আমাদের হেডস্যার বাবু সাধন চন্দ্র খাস্তগীর স্যারের ফোন। সেই ১৯৯৭ সালের পর মাঝখানে দু’বার স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল। তারপর অনেক বছর আমাদের আর দেখা হয়নি। কথা হয়নি। করোনার সময়টাতে একদিন হঠাৎ খাস্তগীর স্যারের ফোন। স্যার, স্যারের আরেক প্রিয় ছাত্রী আয়েশা পারভীন চৌধুরী আপার মাধ্যমে আমার মোবাইল নম্বরটা যোগাড় করে আমার সাথে কথা বলেছেন! আমার বিস্ময় কে দেখে! আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক, আমাদের হেডস্যার, আমাদের খাস্তগীর স্যার এত বছর পরেও আমার কথা মনে রেখেছেন, সত্যিই এই আনন্দ আমি লুকাতেই পারছিলাম না।

কত গল্প করছিলেন স্যার! কী উচ্ছ্বসিত কন্ঠ তাঁর! স্যারের গল্প শুনতে শুনতে খুব নস্টালজিক হয়ে যাচ্ছিলাম। স্যার, স্যারের বেশ কিছু প্রিয় ছাত্রছাত্রীর গল্প করছিলেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন মজনু ভাই, সাখাওয়াত হোসেন মজনু। মজনু ভাই দৈনিক আজাদীতে নিয়মিত কলাম লিখতেন “সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম” নামে। কলামের নামটা ঠিক আছে কি না মনে করতে পারছি না। প্রতি সপ্তাহে সম্পাদকীয় পাতায় কলাম লিখতেন মজনু ভাই। আমরা স্কুলে পড়ার সময় স্যার মজনু ভাইয়ের লেখালেখির গল্প করতেন আমাদের কাছে। স্যার আবু দাউদ নামে তাঁর আরেকজন প্রিয় ছাত্রের গল্প করতেন। সেই আবু দাউদই যে এখনকার বিখ্যাত লেখক সে কথা অনেক পরে জেনেছি।

কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম শহরের পুকুর দিঘি নিয়ে একটা লেখা হয়েছিল আজাদী পত্রিকায়। সেদিন স্যার ফোন দিয়ে বললেন, ঝর্ণা, তোমার লেখায় চট্টগ্রামের পরিচিত প্রায় সব পুকুর দিঘির কথা এসেছে, শুধু দেওয়ানজী পুকুর বাদ গেছে। আমি ভাবছিলাম কত মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন স্যার!

ক্লাস নাইনে স্যার আমাদের ইংরেজি ক্লাস নিতেন। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে অনেক গল্প করতেন। এমন চমৎকার করে বলতেন আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনতাম। সেসময় স্যার একটা গল্প বলতেন যেটা আমার মনে দারুণভাবে গেঁথে গেছে। স্যারের ছাত্রজীবনে স্যার একটা সিনেমা দেখেছিলেন ‘হেডমাস্টার’ নামে। সেই ছবিতে বয়স্ক হেডমাস্টার অবসরে যাওয়ার পরও অনেক ছাত্ররা পড়া নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়লেই মাস্টার মশাইয়ের কাছে ছুটে আসতো। সন্ধ্যার পরে কূপি জ্বালাতে গিয়ে মাস্টার মশাইয়ের গিন্নি দেখতেন কূপির তেল ফুরিয়ে এসেছে। তাই কখনো কখনো গিন্নি বিরক্ত হয়ে বলতেন, ঘরে তেল বাড়ন্ত। কূপি জ্বালানো যাবে না। মাস্টার মশাই গিন্নিকে বলতেন,রাগ করো কেন গিন্নি, একটু দেখো না কোনোভাবে তেল যোগাড়যন্ত্র করা যায় কি না। আরও বলতেন, শোনো গিন্নি, আমরা কূপির তেল যোগাবো, সেই তেলে আমাদের ছাত্ররা বাতি জ্বালাবে, সেই আলোতে সারা পৃথিবী আলোকিত হবে।

গল্পের কথাগুলো কিছুটা এদিকসেদিক হলেও হতে পারে তবে মূলকথা ছিল এগুলোই। গল্প শেষে আমাদের হেডস্যার, খাস্তগীর স্যার আরও বলতেন, আমরা কূপির তেল যোগানোর কাজটা করে যাচ্ছি। তোমাদেরকে বাতি জ্বালিয়ে সব আলোকিত করতে হবে। স্যারের মুখে এই গল্প শুনে শুনে আমরাও একজন বাতিওয়ালার দেখা পেয়েছিলাম।

খাস্তগীর স্যার হলেন আমাদের সেই বাতিওয়ালা।

স্যার যখনই ফোন করেন অনেক গল্প হয় আমাদের। গল্প করার কোনো এক পর্যায়ে স্যার বলেন, তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে আছে তাঁর স্কুল, তাঁর প্রিয় ছাত্রছাত্রীরা। যেখানেই থাকেন না কেন ছাত্রছাত্রীদের যেকোনো ভালো খবরে এখনো উচ্ছ্বসিত হন। স্যারের অনেক সহকর্মী আমাদের স্কুলের অনেক শিক্ষক এখন বেঁচে নেই। সেইসব সহকর্মীদের কথা মনে করে বলেন, আমার সমসাময়িক অনেক সহকর্মীই এখন আর এই ধরাধামে বেঁচে নেই। তাঁদের কথাও খুব মনে পড়ে। বয়স হয়ে গিয়েছে। এখন আর আগের মতো বের হতে পারি না। সবার সাথে দেখা করার সুযোগ হয় না। ফোনেই যোগাযোগ হয়। পত্রিকা পড়ি। তোমাদের কথা ভাবি। হঠাৎ হঠাৎ তোমাদের মতো আমার ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ বাসায় চলে আসে। তখন সময়টা চোখের পলকে কেটে যায়। মাত্র কিছুদিন আগে আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা ফেরদৌসী আপার হাজব্যান্ড মারা গিয়েছে সেই খবর জেনেছি আগ্রাবাদ স্কুলের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। স্যার ফেরদৌসী আপার হাজব্যান্ডের কথা বলে বললেন, ফেরদৌসী আপার হাজব্যান্ড আমার সমবয়সী। আমাদের কত স্মৃতি! সবাই চলে যাচ্ছে একে একে! আসলে আমরা এখন কে কখন চলে যাবো সে অপেক্ষাতেই আছি।

স্যারকে বললাম স্যার আপনাকে দেখতে আসবো খুব শীঘ্রই। স্যার খুব খুশি হয়ে বললেন, “এসো, আসলে অনেক খুশি হবো। জানি তোমরা এখন অনেক ব্যস্ত। সময় বের করা কঠিন। তবু আসলে অনেক খুশি হবো।”

খাস্তগীর স্যারের কথা এলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে ছাই রঙা সাফারি স্যুট পরা দৃপ্ত চেহারার হাসিখুশি মুখটি। আমার এই যে লেখালেখি’র নেপথ্যেও কিন্তু স্যারের ভূমিকা আছে। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমাদের স্কুলে “প্রগতি” নামে একটা শিশুকিশোর পত্রিকার টিম এসেছিল স্কুলভিত্তিক লেখালেখির আয়োজন নিয়ে। স্যার আমাদের ক্লাসে সেই পত্রিকার সদস্যদের নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা কেউ যদি গল্পকবিতা লিখতে চাও, তোমাদের জন্য একটা সুযোগ এসেছে। প্রগতি নামে এই শিশুকিশোর পত্রিকা আমাদের স্কুলের উপর একটা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করবে। সেখানে আমাদের স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের লেখা ছাপাবে তারা তাদের পত্রিকায়। সপ্তাহখানেক পরে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার লেখা “অচেনা পথে” নামে একটা গল্প নিয়ে স্যারের কাছে জমা দিয়ে আসলাম। এরপর অনেকদিন কোনো খবর নেই। আমি তো ধরে নিয়েছি বাতিল হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। তারপর প্রায় মাস তিনেক পরে স্যার একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি আমার বান্ধবী মনিকে নিয়ে স্যারের রুমে যেতেই স্যার আমার হাতে “প্রগতি”র নতুন সংখ্যাটা দিয়ে বললেন, অভিনন্দন, তোমার গল্প ছাপা হয়েছে। আমি তো হা হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। তখন পাশে থাকা মনি বলল, স্যার ঝর্ণা তো লেখিকা হয়ে গেলো। ওকে তো এখন থেকে গল্পকার ঝর্ণা বলতে হবে। মনির কথায় স্যার হো হো করে হেসে বলেছিলেন, তাই তো, একদিন নিশ্চয়ই অনেক বড় লেখক হবে। আজ না হয় তার যাত্রা শুরু হলো।

এখন কোথাও আমার প্রথম লেখার গল্প করতে গেলেই বলতে হয় “প্রগতি” পত্রিকার কথা। কারণ ছাপার অক্ষরে সেটাই ছিল আমার প্রথম লেখা, প্রথম গল্প।

মাত্র ক’দিন আগে স্যার ৮৫ বছর পেরিয়ে ৮৬ বছরে পা রাখলেন! কিন্তু এখনো স্যারের হাসিটা এত প্রাণবন্ত! স্যারের কন্ঠে এত উচ্ছ্বাস! বয়সের গতিতে বয়স বেড়েছে। কিন্তু বয়সের ক্লান্তি আমাদের প্রিয় স্যারকে ছুঁতে পারেনি, এই আনন্দের কোনো সীমারেখা নেই। স্যারের সাথে কথা বললেই মনে হয় এখনো বুঝি আগ্রাবাদ স্কুলের সেই সময়টাতেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

আমরা সৌভাগ্যবান। আমাদের একজন হেডস্যার আছেন, যিনি এই ৮৬ বছর বয়সেও পরম মমতায় তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মনে রেখেছেন। স্যার আপনি আরও অনেক অনেক অনেক দিন সুস্থভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুন। আপনার আশীর্বাদের হাত রাখুন আমাদের মাথার উপর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচেনা গানের অচেনা গীতিকার
পরবর্তী নিবন্ধতৃণমূল মানুষের জন্য শিল্প-সংস্কৃতি শীর্ষক সাংস্কৃতিক আয়োজন