আমাদের প্রাচীন চট্টগ্রাম : পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন | রবিবার , ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের প্রাচীন চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত এক ঐতিহাসিক শহর যা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়, নদনদী, দিঘি, জলাশয় ও পুকুরের জন্য খ্যাত। সমুদ্র তীরবর্তী ও নদী পাহাড়ের মিশ্রণেই এক অপুরূপ সুন্দর শহর। এই শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশে যে অমূল্য বিপুল সম্পদ রয়েছে, তা না শুধু চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, বরং দেশের সমগ্র পরিবেশের জন্যও তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তবে এই সম্পদের সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি এর সুরক্ষা এবং সংরক্ষণের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। প্রাচীন এ ‘চাটিগাঁওর সংস্কৃত উচ্চারণ চট্টগ্রাম। এখনো চট্টগ্রামকে অনেকে চাটগাঁ বলে অভিহিত করে থাকে। চাটগাঁর সাধু রূপচট্টলা। এইতো শুনলাম ইতিহাসের কথা। আরো প্রাচীন সময়ে আজকের এই চট্টগ্রাম ভুমিকে কত নামে ডাকা হতো! সৃষ্টি থেকে আজ পর্যন্ত চট্টগ্রাম কে কত নামে ডাকা হয়েছে তা ইতিহাসে তার সাক্ষী। () কিরাত () সুহ্মদেশ, () ক্লীং বা কালেন, () রম্যভূমি, () চিতাগাঁও, () চিৎগাঁও, () চট্টল, () চৈত্যগ্রাম, () সপ্তগ্রাম, (১০) চট্টলা, (১১) চট্টগ্রাম, (১২) চক্রশালা, (১৩) চন্দ্রনাথ, (১৪) চরতল, (১৫) চিতাগঞ্জ, (১৬) চাটীগাঁ, (১৭) শ্রীচট্টল, (১৮) সাতগাঁও, (১৯) সীতাগঙ্গা, (২০) কাঞ্চননগর, (২১) সতের কাউন, (২২) পুষ্পপুর, (২৩) রামেশ, (২৪) কর্ণবুল, (২৫) সহরেসবুজ, (২৬) পার্ব্বতী, (২৭) খোর্দ্দআবাদ, (২৮) পোর্টো গ্রান্ডো (বৃহৎ বন্দর), (২৯) ফতেয়াবাদ, (৩০) আনক, (৩১) রোশাং, (৩২) ইসলামাবাদ, (৩৩) মগরাজ্য, (৩৪) চিটাগং, (৩৫) ক্রিরাত বাংলা, (৩৬) যতরকুল, (৩৭) চক্রশা, (৩৮) কেলিশহর, (৩৯) আদর্শদেশ, (৪০) পেন্টপোলিস, (৪১) হরিকেল, (৪২) চতুঃগ্রাম, (৪৩) শাৎগঙ্গ, (৪৪) চিৎতৌৎগৌং, (৪৫) চাটিগ্রাম, (৪৬) চাটিজান, (৪৭) সুদকাওয়ান, (৪৮) চাটিকিয়াং, (৪৯) শাতজাম, (৫০) চার্টিগান, (৫১) জেটিগা, (৫২) জাফরাবাদ, (৫৩) হালিশহর, (৫৪) রুহাম রাজ্য।

চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশে পাহাড়ের এক বিশাল উপস্থিতি রয়েছে। আজকের চট্টগ্রাম শহর প্রায় ৬৭০ টি পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এখনো এই শহরে বিশাল বিশাল পাহাড় সৃষ্টির গৌরব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো শুধুমাত্র সৌন্দর্য নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব পাহাড় বৃষ্টির পানি ধারণ করে এবং তা জলাধারে পরিণত হয়, যা পরে নদী ও খালে প্রবাহিত হয়। এভাবে পাহাড়েরা চট্টগ্রামের জল সরবরাহের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। কিন্তু কাঠখোল, পাহাড় কাটার ফলে ভূমিধস, পরিবেশগত ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বেড়েছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যেরও ক্ষতি হচ্ছে, যা পরিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।

চট্টগ্রামের নদী ও খালগুলো জীববৈচিত্র্য ও মানবজীবনকে সুরক্ষা প্রদান করে। কাপ্তাই, কর্ণফুলী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু, মাতামুহুরি, চাদখালী, ডলু, টঙ্গাবতী এবং অন্যান্য নদী এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তি। চট্টগ্রামের কৃষি উৎপাদন ও মৎস্য চাষ নদীগুলোর উপর নির্ভরশীল। তবে আধুনিক নগরায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং শিল্পকারখানার বর্জ্য নদীতে ফেলানোর কারণে এই নদীগুলো দূষিত হয়ে পড়ছে। জলজ জীববৈচিত্র্যও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই নদীগুলোর পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চট্টগ্রামে বহু ঐতিহ্যবাহী দিঘি, পুকুর ও জলাশয় রয়েছে, যা ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ, কৃষি কাজে সেচ এবং মানুষের পানীয় জল সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে লালদিঘি, কাট্টলী দিঘি, মন্দির দিঘি, আসকার দিঘি, বলুয়ার দিঘি, রানীর দিঘি, খান দিঘি, রাজার দিঘি ইত্যাদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক জলাশয় পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে ভূমিকা রাখছে। তবে দুঃখজনকভাবে, শহরের দ্রুত উন্নয়ন এবং জলাশয়গুলোর প্রতি অবহেলার কারণে অনেক জলাশয় দখল হয়ে গেছে বা দূষিত হয়ে পড়েছে। এসব জলাশয়ের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং যথাযথ পুনঃনির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।

চট্টগ্রামে লক্ষ কোটি মানুষের বসবাস এবং তাদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা পরিবেশের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। ঘনবসতি, যানজট, দূষণ এবং খাদ্যজলের অভাবের মতো সমস্যা এই শহরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের উচিত প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করার সময় সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা।

পরিবেশ রক্ষা না করলে, চট্টগ্রাম তার ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র্য হারাতে পারে। তাই পরিবেশগত শিক্ষা, সতর্কতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাহাড় কাটার মতো ক্ষতিকর কাজ বন্ধ করা, নদী এবং জলাশয়ের দূষণ রোধ করা, বৃক্ষরোপণ বৃদ্ধি করা এবং সব ধরনের পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বাসযোগ্যতা রক্ষা করতে পারি।

প্রাচীন চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বশীল আচরণ অত্যন্ত জরুরি। সঠিক পরিকল্পনা, সংরক্ষণ এবং সচেতনতার মাধ্যমে চট্টগ্রামকে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য সরকার, সিটি কর্পোরেশন, স্থানীয় প্রশাসন এবং নাগরিকদের সমন্বিত উদ্যোগ একসাথে কাজ করা আবশ্যক।

লেখক: গবেষক; সভাপতি, বাংলাদেশ ইতিহাস চর্চা পরিষদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ