ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারকে তলবের পর দিল্লিতে বাংলাদেশের দূতকেও যে পাল্টা ডাকা হবে, সেটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তবে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে বক্তব্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছে, এমন নসিহত অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। গতকাল বুধবার বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের এমন প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা তাদের হাই কমিশনারকে ডেকেছি। এটার ব্যাপারে আমরা যা কিছু বলেছি, সেটা তারা গ্রহণ করে নাই; তাদের কিছু দ্বিমত আছে এ বিষয়ে। একইভাবে আমাদের হাই কমিশনারকেও তারা ডেকেছে। এটা খুব অপ্রত্যাশিত না। সাধারণত এটা ঘটে। একজনকে ডাকা, আরেকজনকে ডাকা হয়। খবর বিডিনিউজের।
তিনি বলেন, সর্বশেষ যে বক্তব্য তাদের, তাতে কিছু নসিহত করা হয়েছে আমাদেরকে। এই নসিহত, আমি মনে করি না যে এটার কোনো প্রয়োজন আছে আমাদেরকে এভাবে করার। বাংলাদেশে নির্বাচন কেমন হবে, এটা নিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের উপদেশ চাই না। আমরা, এই সরকার প্রথম দিন থেকে স্পষ্টভাবে বলে আসছে যে, আমরা একটা অত্যন্ত উচ্চ মানের, মানুষ যেন গিয়ে ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই, যে পরিবেশ গত ১৫ বছর ছিল না।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কার নির্বাচনগুলোর সময়ে ভারতের চুপ থাকার সমালোচনা করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এখন ভারত আমাদেরকে এটা নিয়ে উপদেশ দিচ্ছে, এটা আমি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য মনে করি এই কারণে যে, তারা জানে যে এর আগে গত ১৫ বছর ধরে যে সরকার ছিল, যে সরকারের সাথে তাদের অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক ছিল, তখন কিন্তু এই যে নির্বাচনগুলো প্রহসনমূলক হয়েছে, তখন তারা একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। এখন সামনে একটা ভালো নির্বাচনের দিকে আমরা যাচ্ছি, এই মুহূর্তে আমাদেরকে নসিহত করারতো কোনো প্রয়োজন নাই। আমরা জানি আমরা কী করব। আমরা একটা ভালো নির্বাচন করব, যেটাতে মানুষ ভোট দিতে পারবে এবং যাদেরকে ভোট দেবে তারাই নির্বাচিত হবে। যেটা এর আগে গত ১৫ বছরে ঘটেনি। তো, এই জিনিসটা আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের নির্বাচন নিয়ে একই ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, না, বিষয়টা কিন্তু একরকম না। তাদের সাথে আমাদের কিছু যোগাযোগ সবসময় আছে এবং তারা নির্বাচন কমিশনের সাথেও যোগাযোগে আছে। কারণ আমরা চাই যে তারা এখানে তাদের পর্যবেক্ষকদেরকে পাঠাক। সেটা কিন্তু এভাবে একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে যে আমাদের অবস্থানটাকে গ্রহণযোগ্য না এই ধরনের কথাবার্তার পাশাপাশি বলা যে, এই এই রকম হতে হবে নির্বাচন। এই নসিহত আমরা গ্রহণ করতে পারি না বিশেষত এই কারণে যে, তাদের তো এই সেন্টিমেন্ট দেখা যায় নাই গত ১৫ বছর, হঠাৎ করে এটা জেগে উঠল।
এদিকে যারা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত–পাকিস্তানের যুদ্ধ’ হিসাবে দেখাতে চায়, তাদের সামরিক ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। বিজয় দিবসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং অন্যদের বার্তায় বাংলাদেশের নামোল্লেখ না থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে গতকাল এ মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতীয়দের লেখা ইতিহাসেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানের কথা লেখা থাকার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, তাদের বিশেষজ্ঞ যারা, তারাই বলতেছে যে (মুক্তিযোদ্ধারা) যেভাবে নমনীয় করে রেখেছিল পাকিস্তান আর্মি রেজিস্টেন্সকে, সেটা না করলে ভারতের এই বিজয় অর্জনে অনেক সময় লাগত, অনেক বেশি ক্ষয় হত, অনেক মানুষ নিহত হত। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যেহেতু পূর্ববর্তী, আপনি নয় মাস না ধরুন, ছয় মাস ধরুন, তখন তারা পুরোপুরি সক্রিয় হয়েছে। প্রথমে তো একটা রেজিস্টেন্স গেছে, কিন্তু তারপরে তো জুনের দিক থেকে তো পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। তিনি বলেন, এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানটাকে যারা অস্বীকার করেন, মিলিটারি হিস্ট্রি বা মিলিটারি সায়েন্স সম্বন্ধে তাদের কোনো জ্ঞান নেই। তারা এটাকে অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন, কিন্তু অস্বীকার করার কোনো অর্থ হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ছাড়া তারা এই বিজয় অর্জন করতে পারতেন না।
মঙ্গলবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী আলাদা আলাদা বার্তায় বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শ্রদ্ধার সঙ্গে তারা স্মরণ করেছেন ৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করা ভারতীয় জওয়ানদের। কিন্তু তারা তাদের বক্তব্যে বাংলাদেশ এর নাম একবারও নেননি।
মোদীর বার্তায় বাংলাদেশের নাম না থাকার প্রসঙ্গ ধরে করা এক প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এটা অনেকদিন থেকেই, অনেকদিন থেকে। আমি ভারতে পোস্টেড ছিলাম, আপনারা জানেন, দীর্ঘদিন। তারা সবসময় মুক্তিযুদ্ধে আমাদের ভূমিকাটাকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করে। কলকাতায় যেমন এটাকে অন্যভাবে পালন করে, ওই যে ইস্টার্ন কমান্ড দিবস হিসেবে পালন করে। কারণ তারা মনে করে যে, যুদ্ধ করে তাদের সেনাবাহিনী বিজয় অর্জন করেছে। সত্য, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা বিজয় অর্জন করেছে।
বিজয় দিবসে প্রতিবারের মত এবারও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের কাছ থেকে শুভেচ্ছাবার্তা পাওয়ার কথা আরেক প্রশ্নে জানান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।












