পিতাকে খণ্ড–বিখণ্ড করে গ্রেপ্তার এড়াতে গত ১৪ দিন ধরে (২১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬ অক্টোবর) অনেকটা দৌঁড়ের ওপর ছিল আলোচিত হাসান আলী হত্যার অন্যতম প্রধান আসামি তার ছোট ছেলে শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর। চট্টগ্রাম ছেড়ে নোয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, সিলেট, নরসিংদী হয়ে ঠাঁই নিয়েছিল ঢাকায়। প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তাকে ধরতে পারে ভেবে নিজের মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে দিয়েছিল নদীর জলে। পরিবার–স্বজনদের সঙ্গে বন্ধ করে দিয়েছিল যোগাযোগ। পলাতক অবস্থায় তাকে যারা ঠাঁই দিয়েছিল; সেই বন্ধুদেরও বিশ্বাস করেনি। গন্তব্য পাল্টানোর সময় সেইসব বন্ধুদের কাউকে যদি বলতো বরিশাল যাচ্ছি; গিয়েছে সিলেট। সিলেটের কথা বললে গিয়েছে ঢাকা কিংবা নরসিংদী। ঢাকায় অবস্থানকালীনও একাধিকবার স্থান পাল্টেছে বন্ধুদের অবিশ্বাস করে। তাই তার হাতে যখন হাতকড়া পড়াচ্ছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইন্সপেক্টর ইলিয়াস খান, তখন তার চোখে মুখে বিস্ময়। একপর্যায়ে সে বলেই ফেলে, ‘আমাকে কে ধরিয়ে দিয়েছে বলবেন স্যার? আমাকে তো ধরতে পারার কথা নয়।’ ইন্সপেক্টর ইলিয়াস উত্তরে বলেন, এত বড় পাপ করে পালায় বাঁচবি, কেমনে ভাবলি?
ইন্সপেক্টর ইলিয়াস খান আজাদীকে বলেন, জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে আনার সময় কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে বেশ চুপচাপ ছিল। মাঝে মধ্যে এক দু’বার কথা বলছিল। মনে হলো ধরা পড়ে সে নিজেই প্রচণ্ড শকড। পিতাকে খণ্ড–বিখণ্ড করার বিষয়টা বারবার অস্বীকার করছিল সে। তার কথা হলো যা করেছে, সব তার বড় ভাই মোস্তাফিজুর করেছে। সে শুধু সাহায্য করেছে। তবে পিতার এমন নির্মম পরিণতিতে তার মধ্যে এতটুকু অনুশোচনা ছিল না।
শুক্রবার (৬ অক্টোবর) রাত দেড়টার দিকে ঢাকার হাজারীবাগ এলাকা থেকে জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো। ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে পতেঙ্গা সাগরপাড়ে যায় পিবিআই টিম। তবে বেশ কিছুক্ষণ খোঁজার পরও সন্ধান মেলেনি ভুক্তভোগী হাসান আলীর কাটা মাথা। এরপর বেলা পৌনে ১১টার দিকে তাকে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
পিবিআই কার্যালয়ে গিয়েও জাহাঙ্গীর বারবার জানতে চাইছিল সে কীভাবে ধরা পড়লো। সে জানায়, ২০ সেপ্টেম্বর ঘটনার আগেই সে বহুদিন আগের পরিচিত এক বন্ধুকে ফোন দিয়ে রেখেছিল যে, সে ঢাকায় তার কাছে গিয়ে ক’দিন থাকবে। পিতা হাসান আলীকে দুই ভাই মিলে দশ খণ্ড করার পর অংশগুলো বিভিন্ন স্থানে ফেলে দেয়। ঘটনার আগে মা ও স্ত্রী আনারকলিকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলে, আমি এ দুজনকে খুব ভালোবাসি। তাই ঘটনার আগে বোনের জামাইকে ডেকে এনেছিলাম মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। স্ত্রী আনারকলিকেও বাপের বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ছেড়ে যায়নি। এখন অপরাধ না করেও আমাদের সাথে মা আর বউ আসামি হয়ে গেল।
জাহাঙ্গীর বলে, ঘটনার পর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে ভোলা চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে দুজন আলাদা হয়ে যাই। ভোলা থেকে আমি বরিশাল যাই। তবে ভোলায় যে বন্ধুর আশ্রয়ে ছিলাম, সে জানতো আমি সিলেট যাচ্ছি। এমনকি আনারকলিকেও বলিনি আমি কোথায় যাচ্ছি।
ঢাকায় হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর বলে, আমি সেখানে ছদ্মনামে চাকরি নিই। বাড়ি মীরসরাই আর আমার নাম সুমন বলে জানাই। নিজে মোবাইল ব্যবহার করতাম না। তবে অন্যের মোবাইলে ইউটিউবে আনারকলি সাংবাদিকদের কী বলছে, তা দেখতাম। হাজারীবাগ শত শত শ্রমিক কাজ করে। সেখান থেকে আমাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু এতকিছুর পরও স্যারেরা আমাকে ঠিক খুঁজে বের করে ফেলল।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান জানান, হাসান আলী হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত তার ছেলে শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত শুনানি শেষে ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
উল্লেখ্য গত ২১ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় সড়কের পাশে পড়ে থাকা একটি লাগেজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল মানুষের শরীরের ৮টি খণ্ড। এর মধ্যে ছিল ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। প্রত্যেকটি অংশ টেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তবে ওই লাগেজে ভুক্তভোগীর মাথা না থাকায় তাৎক্ষণিক পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ–পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এর আগে খণ্ড–বিখণ্ড এই মরদেহ পরিচয় শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামে পিবিআই কর্মকর্তারা। তারা প্রথমে ফিঙ্গার প্রিন্টের সহায়তায় নিহত ব্যক্তি মো. হাসান বলে শনাক্ত করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হাসান বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া এলাকার সাহেব মিয়ার ছেলে। তার বর্তমান ঠিকানা লেখা আছে সিলেট সদরের সাধুর বাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনি এলাকায়।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইতোমধ্যে ভুক্তভোগী হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০), তাদের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৩২) ও ছোট ছেলে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনারকলিকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তাদের দেওয়া তথ্যে হাসানের শরীরের অন্যান্য অংশ এবং হত্যার বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করে পিবিআই কর্মকর্তারা। গত ২৭ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বাবাকে হত্যার কারণ, কীভাবে হত্যা করা হয় এবং কীভাবে মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় তার বর্ণনা দেন। এরপর ৩ অক্টোবর একই আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন আনারকলি।