আমরা হেরে যাইনি, আমাদের লড়াই চলছে-রাদা আকবর

তালেবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

অনুবাদ : সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ১৬ আগস্ট, ২০২৫ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

 

 

 

রাদা আকবর একজন আফগানিস্তানি শিল্পী যিনি ভিউজুয়াল আর্ট এবং ফটোগ্রাফির জন্যে বিখ্যাত। আফগান নারীদের শক্তিকে বিশ্ব দরবারে হাজির করেছেন রাদা। তাঁর ডকুমেন্টারিতে তালেবানের বিরুদ্ধে অসংখ্য নারীদের প্রতিরোধের বার্তা, ফাইলফুটেজ ইত্যাদি সংকলিত হতে দেখা যায়।

২০২০ সালে রাদা আট আফগান নারীর সাহসী কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে ‘আবারজানান’ (সুপারওম্যান) নামক এক প্রদর্শনীর আয়োজন করেন কাবুলে। তালেবানি শাসনে যা ছিল দুঃসাহসিক কাজ কেননা আট নারীর প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সমাজ এবং তালেবানের শক্ত নীতিকে উপেক্ষা করে নিজেদেরকে বিশ্ব দরবারে মেলে ধরেছে। তাঁদের সংগ্রাম এবং প্রতিরোধের এমন চিত্রায়ন যথেষ্ট সাড়া ফেলে। তাদের মধ্যে ছিলেন নারী ফুটবলার খালিদা পোপালও। যিনি ১৯৯০ সালের দিকে লুকিয়ে খেলেছিলেন নিজের দেশের জন্যে, পরবর্তীতে নারী ফুটবল দল তৈরিতে নেতৃত্ব দেন। রাদা আকবর নিজেকে একজন শিল্পী এবং নারীবাদী কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। জন্ম ১৯৮৮ সালে কাবুলে। সোভিয়েতআফগান যুদ্ধের সময় শৈশব কাটে রাদার, বোমা থেকে বাঁচতেই ঘরের বেসমেন্টে বেশি সময় কেটেছে তার। জন্ম থেকে যুদ্ধযুদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা রাদা নিজেও সময়ের সাথে মজবুত ভিত্তি গড়েছে নিজের। সমাজে নারীর অবহেলিত অবস্থানকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে তার লেন্স কখনোই ক্লান্ত হয়নি। বর্তমানে তালেবানি ক্ষমতার কারণে ছাড়তে হয়েছে নিজের জন্মভূমিও।

২০১৩ থেকে স্বাধীন ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০১৮২০২১ সালের কাজ নিয়ে করেন প্রদর্শনী ‘সুপারওম্যান’। রাদা রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনির কাছ থেকে বিশিষ্ট নারীদের কাজ নিয়ে জাদুঘর তৈরির অনুমতিও পেয়েছিলেন।বিবিসি’র ১০০ শক্তিশালী নারীর তালিকাতেও এসেছে রাদা আকবরের নাম। বর্তমানে কাজ করে চলেছেন আফগানিস্তানে নারীদের অধিকার নিয়ে। তালেবানের বিরুদ্ধে সোচ্চার রাদা মনে করেন সে হেরে যায়নি বরং তাঁর লড়াই চলছে, চলবে।

 

২০২১ সালে আফগানিস্তানে জীবন কেমন ছিল?

স্বাভাবিক। অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার মাঝেই দিন কেটেছে। বাতাসে ভয়ের গন্ধ। কিন্তু একইসাথে প্রত্যেকেই নিজের কাজে মনোযোগী ছিলাম। তখন আমি কাবুলে ‘সুপারওম্যান’র দ্বিতীয় প্রদর্শনী নিয়ে খুবই ব্যস্ত। সামনেই নারী দিবস তাই কাজের চাপও ছিল বেশি। এর কিছুদিন আগেই রাষ্ট্রপতির সাথে মিটিং ছিল, জাদুঘর সংক্রান্ত কাজ আগাবার কথা হয়েছে।

 

পরিস্থিতি এতটাও খারাপ হতে পারে, ভেবেছিলে কখনো?

আমরা সকলেই জানলাম শান্তি চুক্তির প্রক্রিয়া ইতিবাচকভাবে কাজ করবে না। এখানে তো আফগান নারী কিংবা কেউই জড়িত ছিল না। তবুও সবাইকে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারিনি যে মার্কিনরা আফগানিস্তানের উপর হাল ছেড়ে দিবে। সেটিই ছিল সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা।

আফগান নারীদের বর্তমান অবস্থান কি তোমার কাছে এখনো তাজা ঘায়ের মতো?

অবশ্যই। এক বাক্যেই আমি তা স্মরণ করতে পারি। রাতারাতি সবকিছু বদলে গেলো। আমরা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছি। লোকেদের কল্পনার বাইরেও অনেককিছু। কেননা এগুলো তো শুধুই আমাদের ঘরবাড়ি, কাজ, চাকরি নিয়ে নয়। আমরা আমাদের ভবিষ্যত হারিয়ে ফেলেছি। সম্পূর্ণভাবে। আজ অনেক বছর হয়েছে আফগান মেয়ে শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না। উল্টো পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। কিন্তু যদি কিছুটাও ভালোর দিকে যায় তবুও যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।

আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থা কি?

বিশ্বের লোকেরা আদতে আফগানিস্তান নিয়ে কিছুই জানে না। এখনো অনেক গৎবাধা পুরানো গল্পই ঘুরপাক খাচ্ছে। তথাকথিতভাবে যখন আমেরিকা বা ন্যাটো আফগানিস্তানের কথা বলে তখন কেবলই নারী অধিকার রক্ষার একটি বানোয়াট নাটক দেখানো হয়। আসলে আফগানিস্তানের পাঁচ হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে। আমেরিকার এক বছর পূর্বে এবং ব্রিটিশ নারীদের এক বছর পরেই আফগানিস্তানের নারীরা কিন্তু ভোটাধিকার পেয়েছে।

এখানে কেবল ‘পশ্চিমা’ নারীদের জানা বা বলার বিষয় নাএটি সার্বজনীন।

আমি আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত গ্রামের নারীদের দেখেছি যাদের মুক্তির ভাবনা খুবই সুস্পষ্ট। তারা জানে তারা কি চায়। তাদের বড় স্বপ্ন আছে। আনুমানিক বিশ বছর পূর্বে এখানে একটি জেনারেশনের নারীরা তাদের মৌলিক অধিকার হারিয়েছে। যাদের কাজ করার অধিকার ছিল না, পড়াশোনার অধিকার ছিল না কেবল তালেবানি ক্ষমতার কারণে। প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী ছিল কিন্তু চাইতো অন্তত নিজেদের মেয়েদের পড়াশোনা করাতে। একারণেই নয় যে, আমেরিকা তাদের বলেছে, পশ্চিমা বিশ্ব তাদের বলেছে কিংবা অন্য কেউ। মূলত তারা জানতো তাদের পড়াশোনা করতেই হবে। জানতো, তাদের ভালোসুন্দর একটি জীবন চাই। তাদেরকে মুক্ত করে দিতে চেয়েছে শুধু।

তোমার মা চেয়েছে তুমি স্বাধীনভাবে বাঁচো? আর তোমার বাবা?

দুজনেই। তারা চেয়েছে তাদের মেয়ে যেন অর্থনৈতিক দাসত্ব থেকে বেরিয়ে নিজের স্বাধীনতা অর্জন করে, নিজেদের মুক্তির কথা বলতে পারে, যারা নিজেদের অধিকারের কথা বলতে পারে না তাদেরও ভাষা হবে। তারা চেয়েছিল আমি মানুষের জন্যে লড়ি। যে যুদ্ধে আমরা বলি হয়েছি সে যুদ্ধ তো আমাদের ছিলই না। হ্যাঁ যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ তো ছিল আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে। আমেরিকার সাথে আরবের, পাকিস্তানের কিংবা ইরানের। আমরা শুধুই সহ্য করে গেছি, ভুগেছি। অনেক বেশি মাত্রাতেই ভুগেছি।

আফগানিস্তানে থাকা নারীদের সাথে যোগাযোগ হয়?

হ্যাঁ। প্রায় হয়। বিষয়টি খুবই হৃদয়বিদারক, শরণার্থী হয়ে বাঁচা এবং জীবন যুদ্ধের অপরাধবোধ নিয়ে থাকা। যদিও আমরা এখনো বেঁচে আছি, স্বাধীনভাবেই কিন্তু আমাদের কোনো সুন্দর জীবন নেই। সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। দ্রুত মানিয়ে নেওয়া, কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুনর্বাসিত হওয়া, সবকিছুই খুব কঠিন। তবে এখনো শিল্পকর্মের মাধ্যমে আওয়াজ তুলতে পারছি, নিজের জন্যে নতুন কিছু করার সুযোগ আছে মনে করি। কিন্তু আফগানিস্তানের নারীদের তো মৌলিক অধিকার অব্দি নেই। তারা বঞ্চিত স্রেফ। আমরা কিছু করতেও পারছি না। সব মিলিয়ে দুঃখজনক।

এক বছরেরও বেশি সময়তে এভাবে উৎখাত! কিভাবে দেখছো? এতে তোমার শিল্পকর্মে কিরূপ প্রভাব পড়েছে?

আমার কাজে নির্বাসিত জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো আনার চেষ্টা করছি। যেমন আমার নিজস্ব ভাষা কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে কাজ করছি। আমার ভাষাতে আমি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি না। দেশে একজন স্বাধীন ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছি, সকলের সাহায্য পেয়েছি। এখানে ব্যাপারটা ভিন্ন। অনেক পেশাদার আর্টিস্টই আমাকে বলেন, তোমার কাজ জাদুঘরে রাখার মত সুন্দর কিন্তু বিক্রির মতো না। তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে আরো পেশাদার জায়গা থেকে ভাবতে হবে। আমি জানি বেশিরভাগ শিল্পীকেই বেঁচে থাকতে এমনটা করতে হয় কিন্তুই তাই বলে আমাকেও কি আমার মানবিক শিল্পকে বাণিজ্য করে তুলতে হবে? আমি চাই না আমার শিল্পের মূল ভিত্তি ত্যাগ করতে।

কাজের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কেন মানবাধিকারকেই বেছে নিয়েছো?

আমরা এমন একটি সমাজে বসবাস করি, যেখানে শুধু নারী বলে প্রতিদিনই বৈষম্যের শিকার হতে হয়। এভাবে ভাবাটা খুবই ক্লান্তিকর, গ্লানির। আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাই। আমার কাজ, শিল্প এমন এক হাতিয়ার যা আমাকে এসব নিয়ে কথা বলতে দেয়। নিষিদ্ধ বিষয়গুলো মোকাবেলা করতে সহজ হয়।

পশ্চিমা’তে তোমার কাজকে কিভাবে দেখা হয়?

আমি দেখেছি লোকে আমার কাজকে ভালোবাসে, কৌতূহলী হয়। যদিও অনেকেই বলে, আমার কাজ নাকি অনেক বেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং ভারী। তারা আরো হালকা কিছু চায়। কিন্তু এইসবই আছে আমার কাছে যা আমি দেখাতে পারি এবং দেখাতে চাই। কেননা এটাই বাস্তবতা। বরং বাস্তবে চিত্র আরো খারাপ, দুর্বিষহ। দিনে দিনে দিগুন হচ্ছে কেবল।

আমরা আসলে কিভাবে আফগানিস্তানি নারীদের সাহায্য করতে পারি?

সকলের আসলে আফগানিস্তানের মূল অবস্থাটা জানা জরুরি এবং একে নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে এবার। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা ৪০ মিলিয়ন মানুষদের জন্য লড়ব যাদেরকে তালেবানিরা বন্দী করে রেখেছে। নারীরা নিজেদের ঘরেই বন্দী। নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে; কি হতে চলেছে সামনে? পুরো বিশ্বে কি প্রভাব পড়বে? শুনুন, এটা আফগানিস্তানে হতে পারলে, বিশ্বের যেকোনো দেশেই হতে পারে। হয়তো এখন না কিন্তু যেকোনো সময়। আমাদের অধিকার আছে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের প্রশ্ন করা এবং তাদেরকে জবাবদিহি করানো।

তথ্যসূত্র: আইএসগ্লোবালে দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর সুরক্ষায় সংবিধান
পরবর্তী নিবন্ধ‘মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে সমৃদ্ধ দেশ গড়তে কাজ করছে ছাত্র শিবির’