মধ্যযুগে ইউরোপসহ সমগ্র প্রতীচ্য যখন দারিদ্র, অশিক্ষা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ভারতবর্ষে তখন চলছিল সভ্যতার স্বর্ণযুগ। আমাদের বঙ্গভূমিকে তখন বলা হত ‘প্যারাডাইজ অব ইন্ডিয়া’। ‘জান্নাতুল বিলাদ’ও বলা হত। পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ ভাগ্য ফেরানোর আশায় তরি ভেড়াত বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, মেঘনা, যমুনা, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, সুরমা’র ঘাটে (ঠিক এখন যেমন আমাদের যুবকেরা ভিড় করে ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে, অথবা টেমস, মিসিসিপি, অটোয়া, প্যারামাত্তা, ইয়ারা নদীর উপত্যকায়)। ইছামতী’র তীরে দিগন্ত জোড়া কার্পাস ক্ষেতের তুলা দিয়ে নির্মিত হত পৃথিবী কাঁপিয়ে দেওয়া বস্ত্র স্বচ্ছ ফিনফিনে মহামূল্যবান মসলিন। ইউরোপের রাজপরিবারের অভিজাত নারীরা মুখিয়ে থাকত একখণ্ড মসলিনের জন্য। ইরান-তুরান, সমরখন্দ-বুখারা, কাবুল-কান্দাহার কেবল নয়, সুদূর পশ্চিম ও পূর্ব ইউরোপ থেকে কপর্দকশুন্য ভাগ্যান্নেসিরা এসে মসলিনের বদৌলতে ধনকুবের বনে যায়। রাজনৈতিক অভিলাষও জাগে কারও কারও মনে, তবে ক্ষমতার পালাবদলের ফেরে শেষ পর্যন্ত থিতু হয় ইংরেজরা।
এ-গল্প সকলের জানা। এ-ও কারও অজানা নয় যে ইংরেজ ঘাঁটি গাঁড়ার পর বছর গড়াতে না গড়াতেই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। বাঙালি এখানেও এগিয়ে। নীল চাষিরা, ফরায়েজিরা, ফকির-সন্ন্যাসীরা, তিতুমিরের অনুসারীরা, সিপাহীরা, স্বদেশীরা একের পর এক আন্দোলন চালিয়ে যায়। টানা একশ নব্বই বছর পর হার মানে ব্রিটিশ রাজশক্তি, হাত গুটিয়ে নেয় বাংলা তথা ভারতবর্ষ হতে। স্বাধীনতা তখনও অধরা। নতুন প্রভুর আসনে বসে পাক সামরিক জান্তা। তারাও আমাদের প্রাণের বাংলায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে একদিন ফিরে যায় নিজ মুলুকে। তাই বলে বঙ্গভূমিতে শোষক নেই আর?
এটাও কারও অজানা নয় যে সোনার বাংলায় আজ যে শোষকগোষ্ঠী বর্তমান তারা আপনার লোক, স্বজাতীয়। তারা তাই হার মানবে না কোনদিন। ফিরেও যাবে না কোথাও, যদিও ক্রমাগত অর্থপাচার আর তৃতীয় চতুর্থ আবাসভূমির বদৌলতে স্থায়ী ঠিকানা তৈরি তাদের নানান মহাদেশের নামীদামী শহরে। এ-দেশটাকে শোষণ করার জন্য তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় সিংহাসন হাতবদল হলেও তারা অক্ষত, অটল, অনড় অলৌকিক শক্তি বলে। আমজনতা, জনসাধারণ, রাষ্ট্র গঠনের দ্বিতীয় উপাদান ‘জনসমষ্টি’; পৌরবিজ্ঞান আদর করে যাদের ‘নাগরিক’ অভিধা দিয়ে জাতে উঠিয়েছে, তাদের কাজ চেয়ে-চেয়ে দেখা, মাথা নত করে কুর্নিশ করে যাওয়া। নজরুলের ‘মোসাহেব’ কবিতার প্রকৃত চিত্রায়নের মাধ্যমে দিন ফেরাতে পারে কেউ কেউ। শোষকগোষ্ঠীর তল্পিবাহক, ধামাধরা থেকে পদন্নোতি পেয়ে শেষমেশ শোষকদের কাতারে মিশেও যেতে পারে কপালের জোরে। এমনি করে স্বর্গরাজ্য লুটপাটের মহোৎসব জমে ওঠে দিনে দিনে।
জনতার কাজ ক্রমাগত হাততালি দিয়ে যাওয়া, উদযাপনে সামিল হওয়া। পেটে ভাত নেই? মাথার ওপর ছাদ নেই? অসুখ-বিসুখে গেলার মতো বড়ি নেই? ছেলেমেয়েদের জন্য বইখাতা নেই? এসব কথা বলতে নেই। দু’হাজার দুশো সত্তর ডলারে পৌঁছে গেছে জাতীয় মাথাপিছু আয়। হাড় হা-ভাতেদের মনগড়া নালিশ শোনার সময় কই আমাদের? ঠুনকো দাবি দাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলবে? গণ্ডামারা’র কথা এত অল্পদিনে ভুলে গেলে?
দারিদ্রের সকল চিহ্ন মুছে দিতে হবে বাংলা মায়ের বুক হতে। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সাফ করে অট্টালিকায় ভরে দিতে হবে দেশটাকে। গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে গড়ে তুলতে হবে ঝা-চকচকে নগর। নির্মাণ সামগ্রী নিম্নমানের হোক, অট্টালিকার গাঁথুনি দুর্বল হোক, ক্ষতি নেই। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ঝুরঝুর করে ধুলোয় মিশে যাবে? শত সহস্র মানুষ মারা পড়বে? তাতে কি? অট্টালিকা নির্মাণ বন্ধ করা চলবে না। দ্রুততম সময়ে বহুতল ভবন নির্মাণে আমাদের জুড়ি নেই পৃথিবীতে।
ফলদানকারি বৃক্ষরাজি, সোনা ফলানো আবাদি জমি, খেলার মাঠ উজাড় করে ইটভাটার চুল্লি জ্বলছে দিনরাত? জ্বলুক না। নগরীর বুকে ইস্পাত কারখানার গনগনে আগুন নাইবা নিভুক। আকাশ কালো করে ভেসে বেড়াক বিষাক্ত ধোঁয়া। বাতাস ভারি হয়ে থাকুক বিষভরা সীসায়। কে জানে, প্রাণহীন এই শহরে বিষই হয়তো বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের সন্তানদের! শরীর থেকে অন্তরে ছড়িয়ে পড়া বিষ থেকে জন্ম নেওয়া ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে গৌরবময় ইতিহাস ঐতিহ্যের সকল স্মারক।
নদীর কথা তো বলা হয়নি। মরা নদীর উপাখ্যান শোনার সময়ই বা কোথায় আমাদের! দেশমাতার শিরায়-শিরায় বয়ে যাওয়া শতশত নদীর আর প্রয়োজন আর নেই আমাদের। নৌকাডুবি, জাহাজডুবির কি শেষ আছে? তাছাড়া নদী আর খালেবিলে, পুকুরে প্রতিদিন ডুবে মরে ছেলে বুড়ো কেউনা কেউ। ডিজিটাল বাংলাদেশে সাঁতার শিখে নষ্ট করার মতো সময় আমাদের নেই। অতএব ভরাট করে ফেলা হোক নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা। মৃত জলাশয়ের ওপর নির্মিত হোক বিপণি বিতান, কল-কারখানা, প্রমোদ নগরী। রাষ্ট্রীয় সম্পদের নয়ছয় হোক, কারও কিছু যায় আসে না। লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে আমরা সবাই রাজা। যে যা পারি হাতিয়ে নেই তাই।
কে বলে দেশটা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে? আমরা তো বেশ আছি। জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদের তেজ গায়েই লাগে না, হিমশীতল ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রায় নিমগ্ন। দাসি-বাঁদি, চাকর-বাকর, দারোয়ান-গাড়োয়ান নিয়ে কি এক এলাহি কাণ্ড! সেবায় দণ্ডায়মান তারা সর্বক্ষণ ক্রীতদাসের মতো। বিশ্বের সেরা ধনকুবেরদের কপালেও এত আরাম আয়েশ জোটে না। জরুরি প্রয়োজনে দেশত্যাগের সময় দু’চার জন দাসদাসিকে সঙ্গে করে উড়িয়েও নিয়ে যেতে পারি আমরা। এতটাই প্রভাবশালী নব্য বাংলাদেশের ধনবান সমপ্রদায়। ইংরেজ আমলে সাদা চামড়ার প্রভুরা এমনি করেই শোষণ করত আমাদের আদিপিতাদের। ওরা নেই বলে শোষণ থেমে যাবে? তাইতো ওদের স্থান নিয়ে নিয়েছি আমরাই। এখন তাই আমরা সবাই রাজা।
পুনশ্চঃ না, আমাদের সন্তানরা রাজা হবে না। রাজা হতে চায়না ওরা। মৃত্যুপুরি’র রাজা হওয়াতে গৌরব নেই, স্বস্তি নেই, আনন্দ নেই। আমাদের সন্তানদের জন্য এই দেশটাকে বাসযোগ্য করা চাই, বাতাসটুকুকে বিষমুক্ত বিশুদ্ধ রাখা চাই, সমাজটাকে সুস্থ আর নিরাপদ রাখা চাই। এ-কাজ শুধু সরকারের নয়, শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও নয়। এ-কাজ আমাদের সকলের। আমরা অপরাধ থেকে দূরে থাকব শুধু কি শাস্তির ভয়ে? সৎ থাকার স্বস্তি ও আনন্দটুকু আমরা গ্রহণ করবো না? আমাদের সন্তানদের মাঝে সেই আনন্দ ছড়িয়ে দেব না ? ওরা যে তাকিয়ে আছে আমাদেরই দিকে।