কয়েকশ মানুষ হাত তুলে শপথ করলেন, তারা কোনো পাহাড় কাটবেন না, টিলা কাটবেন না, ড্রেসিংয়ের নামে পাহাড়ের ক্ষতি করবেন না, কাউকে করতেও দেবেন না। কোনো জলাশয় ভরাট করবেন না। তারা লিখিতভাবেও এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
ব্যতিক্রমী এক আয়োজনে নগরীর সবচেয়ে বেশি পাহাড় সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত আকবরশাহ থানা এলাকার চার শতাধিক ভূমি মালিক গতকাল রোববার হাত তুলে এবং লিখিতভাবে এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ সাদি উর রহিম জাদিদের হাতে অঙ্গীকারপত্র তুলে দিয়ে তারা শপথ নেন, এলাকার পাহাড়গুলো তারা পাহারা দিয়ে রক্ষা করবেন।
নগরে সবচেয়ে বেশি পাহাড় রয়েছে আকবরশাহ থানা এলাকায়। এখানে রাতে–দিনে পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে। এলাকার যে পাহাড়গুলো এখনো টিকে আছে সেগুলো রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ব্যতিক্রমী এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক সোনিয়া সুলতানা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ সাদি উর রহিম জাদিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরাফাত সিদ্দিকী, ৯ নং উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও আকবরশাহ থানা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সাত্তার সেলিম, আকবরশাহ থানার ওসি তদন্ত মোহাম্মদ আফতাব হোসেন ও বেলা চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মুনিরা পারভীন রুবা।
সভায় অংশ নেওয়ার জন্য এলাকার ভূমি মালিকদের দাওয়াত করা হয়। এতে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের জয়ন্তিকা ও উত্তর লেকসিটি এলাকার চার শতাধিক ভূমি মালিক অংশগ্রহণ করেন। এদের কারো পাহাড়, কারো টিলা এবং কারো জলাশয়ের মালিকানা রয়েছে। অনুষ্ঠানে তারা পাহাড়–টিলা কর্তন ও মোচন এবং জলাশয় ভরাট করবেন না বলে লিখিত অঙ্গীকার করেন। সবাই হাত তুলে ও লিখিত অঙ্গীকারপত্র প্রদান করে বলেছেন, আমরা আমাদের পাহাড় টিলা ও জলাশয় রক্ষা করব।
সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে জয়ন্তিকা আবাসিক প্লট মালিক কল্যাণ কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সকলের পক্ষে অঙ্গীকারপত্র তুলে দেন। ভূমি মালিকদের পক্ষে বক্তব্য রাখেন কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ওহীদুল ইসলাম, সদস্য সচিব মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন ও ভূমি মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মো. আক্কাস আলী।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. সাদি উর রহিম জাদিদ বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধিত ২০১০ অনুযায়ী সরকারি–বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় বা টিলা, ছনখেলা কিংবা দৃশ্যমান পাহাড়, জলাশয় যাই হোক না কেন, তা কাটা, মোচন বা ভরাট করা এবং যে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ। পাহাড় পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষাকারী। জলাশয় বিপদের বন্ধু। প্রকৃতির অপার সৃষ্টি এই পাহাড়–টিলা কিংবা জলাশয় মানবজাতির বেঁচে থাকার উৎস। এটিকে কোনোভাবেই নষ্ট, ক্ষতিসাধন কিংবা মোচন করা যাবে না। আমার পরিবারের জন্য পৃথিবীর শত–হাজার কোটি মানুষের ক্ষতি আমরা করতে পারি না। সুতরাং আমাদের কঠোর এবং শেষ বার্তা হচ্ছে, বন–পরিবেশ–প্রকৃতি কিংবা জলাশয় নিশ্চিহ্ন করে কিংবা ক্ষতি করে কোনো আবাসনের সুযোগ নেই। নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে পাহাড়–টিলা থেকে আপনারা সরে যান। জলাশয় তথা খাল, পুকুর, নদীসহ জলাধার ভরাট করে কিংবা দখল করে যারা স্থাপনা করেছেন বা করছেন তারা তা উন্মুক্ত করে দিন।
তিনি বলেন, আমরা আকবরশাহ এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছি। পরিবেশ আইন সবার জন্য। সুতরাং আপনারা নিজেরা যদি সচেতন হন তাহলে আপনাদের উচ্ছেদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে কিছু করেন তাতে কোনো ছাড় পাবেন না।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আরাফাত সিদ্দিকী পরিবেশ–প্রকৃতির প্রয়োজনীয়তা, আইন অমান্যের শাস্তি ও ভূমি মালিকদের করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। সুন্দর আগামীর জন্য পাহাড়–টিলা ও জলাশয় অবমুক্ত তথা সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দেওয়ার আহ্বান জানান।
আকবরশাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) পাহাড় কাটার সংবাদ পুলিশকে জানানো এবং পাহাড় বা টিলায় একটি কোপও যেন না দেওয়া হয় এ ব্যাপারে সতর্ক করে যে কোনো প্রয়োজনে কিংবা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য থানা পুলিশের সহযোগিতা নিতে আহ্বান জানান। এই ধরনের অপরাধ কেউ করলে পুলিশকে জানাতে ভূমি মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক সোনিয়া সুলতানা বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত পাহাড়–টিলা কর্তন ও জলাশয় ভরাটের তথ্য পাচ্ছি। আকবরশাহ থানা এলাকাতেও এগুলো হচ্ছে। প্রতিনিয়ত অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও মামলা দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আমরা চাই না আপনাদের কষ্ট দিতে। আপনারা যদি পাহাড়–টিলা বা জলাশয় মোচন থেকে বিরত থাকেন এবং পরিবেশ আইন মেনে চলেন, আমাদের এসব করতে হয় না। আসুন আমরা সবাই মিলে পাহাড়–টিলা ও জলাশয় তথা পরিবেশ সুরক্ষায় কাজ করি।