অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আয়োজিত চট্টগ্রাম আঞ্চলিক মতবিনিময় সভায় কমিটির সভাপতি, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, দেশে দুর্নীতি অতি ব্যাপক এবং অনেক গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। যাদের আইন প্রণয়নের কথা তারাও যুক্ত হয়েছেন। যাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়ার কথা, তারাও যুক্ত হয়ে গেছেন। যারা আইন প্রয়োগ করার কথা তারাও যুক্ত হয়ে গেছেন। এতে বোঝা যায়, সামগ্রিকভাবে আমরা যে সমস্যার মোকাবেলা করছি তার আয়তন, তার ব্যাপ্তি ব্যাপক ও গভীর। তাই প্রতিটি মানুষের পরিবর্তনে অংশগ্রহণ থাকতে হবে। প্রথম কথা হল, পুরনো সিন্ডিকেটের বদলে আমরা নতুন সিন্ডিকেট চাই না। এটা তো হতে পারে না যে, আমরা রাজনীতির বদল করলাম না, শুধু রাজার বদল করে ফেললাম। এটা তো হতে পারে না।
গতকাল শনিবার বিকেলে নগরীর একটি হোটেলে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির উদ্যোগে চট্টগ্রামের সমাজসেবী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী সমাজের প্রতিনিধি, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, অন্যান্য পেশাজীবী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম কর্মীসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
সভায় ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই অবস্থা এককভাবে কারো পক্ষেই পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটি মানুষকেই এই পরিবর্তনের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা চোর ধরতে আসিনি। চুরির প্রক্রিয়া কী, কিভাবে তা রোধ করা যায় সেটা বের করতে এসেছি। কেউ আমাদের অবস্থা পরিবর্তন করে দিয়ে যাবে, এটি হবে না। নাগরিক অধিকারকে আমাদের উসুল করে নিতে হবে। এটির জন্য নির্বাচন একটি পদক্ষেপ। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত নাগরিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্যটা বুঝে নেওয়ার সুযোগ। এই সুযোগ যদি আমরা হারাই, আবার কোনো দিন খুঁজে পাব কি না জানি না।
এসময় অন্যদের মধ্যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, ফেরদৌস আর বেগম, ড. ইমরান মতিন, ড. কাজী ইকবাল, ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফ, অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, ড. সেলিম রায়হান ও শরমিন্দ নীলোর্মি উপস্থিত ছিলেন। সভায় প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবীদ মু. সিকান্দার খান, বিএসআরএম’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমেরআলী হুসেইন, প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক পরিচালক জাফর আলম, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা, বেসরকারি উন্নয়ন কর্মী জেসমিন সুলতানা পারু, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন সাকী, রাজনৈতিক নেতা হাসান মারুফ রুমি, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জুবায়ের আলম, হিজড়াদের নেতা ফাল্গুনী হিজড়া, আদিবাসী শিক্ষার্থী পহেলা চাকমাসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
মতামত তুলে ধরতে গিয়ে মু. সিকান্দার খান বলেন, দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না। এখনই ঠিক করা উচিত। দ্রব্যমূল্য চরম ঊর্ধ্বমুখী। মানুষজন কষ্ট করছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ছোট ছোট পরিবর্তনগুলো না হলে বড় পরিবর্তন আসবে না।
প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, সঠিক পরিকল্পনা না নিলে যানজটের কারণে চট্টগ্রামের অবস্থা ঢাকার চেয়েও খারাপ হবে। অপ্রয়োজনী প্রকল্প বাদ দিয়ে জনমুখী প্রকল্প গঠন করতে হবে। প্রতিটি প্রকল্প নেয়ার আগে স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ নিতে হবে।
বিএসআরএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমেরআলী হুসেইন বলেন, আমরা মারাত্মক এক সংকটে আছি। একটি বেসিক সার্ভিসও পাওয়া যাচ্ছে না। এনআইডি বলেন, ট্রেড লাইসেন্স বলেন, বন্দর বলেন, মিনিস্ট্রি বলেন সব জায়গায় কাজের যে দীর্ঘসূত্রতা এটার কারণে বছরের হাজার হাজার কোটি টাকা ডেমারেজ হচ্ছে। এটাও হিসেবে নিতে হবে।
ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক জুবায়ের আলম বলেন, আগের সিন্ডিকেট আমরা তাড়িয়েছি। এখন নতুন সিন্ডিকেট সবকিছু দখলে নিচ্ছে। হাট–বাজার, শিল্পকারখানায় নতুন সিন্ডিকেট তৈরী হচ্ছে। আমার বাড়ি আনোয়ারায়। অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে ফোন পাই, এসব বিষয় নিয়ে।
পহেলা চাকমা বলেন, জাতিগত পরিচয়ের কারণে আমরা অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। সংবিধানে আমাদের যথাযথ পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে সামাজিক বৈষম্যও দূর করতে হবে।