জলাবদ্ধতায় নাগরিক যন্ত্রণা চরমে পৌঁছেছে। হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি। নগরীর বিস্তৃত এলাকার বাসাবাড়ির নিচতলা পরিত্যক্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বহু এলাকাতেই মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। জ্বলেনি রান্নার চুলা। মাত্র চারদিনের বৃষ্টিতে নগরীর বিস্তৃত এলাকায় এই দুর্ভোগ। এই পরিস্থিতি এবং শহরটি বাসযোগ্য না থাকার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে। এদের দায় অস্বীকার করারও সুযোগ নেই। কিন্তু এই দুর্ভোগ সৃষ্টির জন্য আমরাও কী কম দায়ী?
পৃথিবীর নান্দনিক শহরগুলোর একটি ছিল চট্টগ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য প্রাচ্যের রাণী নামেও এর পরিচিতি। সাগর, নদী এবং পাহাড়ের এমন নান্দনিক সমন্বয় পৃথিবীর খুব কম শহরের ভাগ্যেই জুটে। যারা এমন সুযোগ পেয়েছে তারা তা কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফিরিয়েছে। অথচ চট্টগ্রামকে যেখানে নেয়ার সুযোগ ছিল সেখানে তো নেয়া যায়নি। উল্টো দিনে দিনে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছে। নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রামের প্রকৃতি দারুণভাবে প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। কিন্তু কেমন এমন হলো! এর দায় কি শুধুই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের? আর কি কেউ এরজন্য দায়ী নয়, দায়ী নই কি আমরা?
বহু বছর ধরে শহরে একটির পর একটি পাহাড় কাটা হয়েছে। আমরা এটা রোধ করতে পারিনি। শহরে একটির পর একটি জলাধার নষ্ট হয়েছে, পুকুর দীঘি ভরাট হয়েছে। আমরা মাথা ঘামাইনি। শহরের খালগুলো প্রভাবশালীরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে দখল করে নিয়েছে। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে অনেকগুলো খাল।
শহরে যে কয়টি খাল যতটুকু আছে সেগুলো শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়। এসব খাল খনন এবং সম্প্রসারণ করা দরকার। জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রকল্পের আওতায় খালগুলোতে নানাভাবে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু একদিকে পরিষ্কার করে যেতে যেতে অন্যদিকে ভরাট হয়ে যাচ্ছে ময়লায়। প্রতিদিন নগরীর খালগুলোতে হাজার হাজার টন ময়লা আবর্জনা ফেলছি আমরা। আমরাই ফেলছি পলিথিনসহ নানা ধরনের অপচনশীল বর্জ্য। ৩০ বছর আগেও খালগুলোর এমন চিত্র ছিল না। অথচ দিনে দিনে আমরাই খালগুলো মেরে ফেলছি, শেষ করে দিয়েছি, দিচ্ছি। যা শুধু খালই নয়, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে সর্বনাশা প্রভাব ফেলছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলীর তলদেশ থেকে ময়লা আবর্জনা তুলতে গিয়ে আবিষ্কার হয় যে, নদীর তলদেশে অন্তত বিশ ফুট পুরু পলিথিনের আস্তর তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ নদী বিশ ফুট ভরাট হয়েছে শুধু পলিথিন দিয়ে। চীন থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ কাটার এনেও এই পলিথিনের আস্তর কেটে তোলা সম্ভব হয়নি। নদীর তলদেশে বিশ ফুট উঁচু পলিথিনের পাহাড় তৈরি হওয়ায় নদীর ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এতে করে আগে কর্ণফুলী নদী বৃষ্টির যত পানি ধারণ করতে পারতো এখন আর তা পারছে না। ফলে নগরীতে ফুলে উঠছে পানি। প্রতিবছরই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। শুধু পানির ধারণক্ষমতাই নয়, নিচে পলিথিনের বিশাল আস্তরণ তৈরি হওয়ায় মাছ বসবাসের পরিবেশও নষ্ট হয়ে গেছে। শুধুমাত্র আমাদের অবিবেচকের মতো কর্মকাণ্ডই এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পলিথিনসহ ব্যবহৃত বর্জ্য যদি এভাবে যেখানে সেখানে ফেলা না হতো তাহলে পরিস্থিতি এত ভয়াবহ হতো না।
এত বিপর্যয়ের মাঝেও আমাদের যে বোধোদয় হচ্ছে না তার দৃষ্টান্ত নগরীর সর্বত্রই দৃশ্যমান। আমাদের নাগরিক বোধ নেই, আসেনি নাগরিক সচেতনতা। বিপদ এল, বিপর্যয় এলে আমরা অন্যকে দায়ী করি। দায় চাপাই। কিন্তু এ শহরকে বসবাস উপযোগী রাখার জন্য নিজের নাগরিক দায়িত্বটুকু পালন করি না।