পুরো বিলজুড়ে হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনালী ধানের ছড়া। এরমধ্যে কিছু কিছু ক্ষেতে শুরু হয়েছে ধান কাটা উৎসব। যেখানে কেউ কাটছেন ধান, কেউ বাঁধছেন আঁটি এবং কেউ কেউ সেই আঁটি কাঁধে করে ছুটছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল চট্টগ্রামের শস্যভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত রাঙ্গুনিয়ার গুমাই বিলের নিত্যদিনের চিত্র এটি। উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নজুড়ে বিস্তৃত পঞ্চাশটিরও বেশি গ্রামের ১০ হাজার অধিক কৃষকের আবাদ করা আমন কাটার উৎসব শুরু হয়েছে। শুধু এই বিলে নয়, উপজেলার অন্যান্য জমিতেও পাকা ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষক পরিবার।
গেলবার উপজেলায় ৫.১ টন ফলন পাওয়া গেলেও এবার ফলন আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে তারা ন্যায্য দাম থেকে যেন কোনোভাবে বঞ্চিত না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেন। এছাড়া গুমাইবিলের যাতায়াত, সেচ সুবিধা, দখলের কবল থেকে রক্ষা করাসহ এই বিল রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, আমন মৌসুমে এবার রাঙ্গুনিয়ার ১৫ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হলেও আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে গুমাইবিলের প্রায় ৩৫শ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে বন্যায় কৃষি মাঠ প্লাবিত হলেও বন্যা সহনশীল জাতের আবাদ হওয়ায় তা তেমন কোনো প্রভাবই পড়েনি। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ব্রিধান–১০৩ এর নমুনা শস্য কাটার পর দেখা গেছে ৬.৩ টন ফলন এসেছে। যেখানে গতবার গড় ফলন ছিল হেক্টর প্রতি ৫ থেকে সাড়ে ৫ টন।
সরেজমিনে গুমাই বিলে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়ক পথে মরিয়মনগর চৌমুহনী পেরুতেই গুমাই বিলের সারি সারি ধানক্ষেতের দেখা মিলল। সোনালি ধানে ভরে গেছে মাঠ। হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে ধানের ছড়া। নানা জাতের পাখি ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে মাঠে। বিলের মরিয়মনগর, কাটাখালি, স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া এলাকায় ধান পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করলেও কাটা শুরু হয়নি। তবে চন্দ্রঘোনা হাবিবের গোট্টা থেকে লিচু বাগান পর্যন্ত ইতিমধ্যেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। সেখানে কৃষকদের কেউ ধান কেটে ঘরে আনছেন, কেউ কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে পুরো গুমাইবিলে পুরোদমে ধান কাটতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে বলে জানান কৃষকরা।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে গুমাইবিলের নানা সমস্যার কথা জানিয়েছেন কৃষকরা। তারা জানান, রাঙ্গুনিয়া পৌরসভা ছাড়াও চন্দ্রঘোনা, মরিয়মনগর, হোছানাবাদ ও স্বনির্ভর রাঙ্গুনিয়া এই চার ইউনিয়নজুড়ে গুমাইবিল। প্রায় ৪০০০ হেক্টর আয়তনের বিস্তৃত গুমাইবিলের মাঝখানে কিংবা শেষ প্রান্তে যাতায়াত অসুবিধার কারণে চাষের খরচ বেশি লাগে। তাই প্রতি মৌসুমেই বেশ কিছু জমি অনাবাদি থেকে যায়। এছাড়া এবার এই বিলে ধানে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে কিছু ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া গুমাইবিলের অন্যতম প্রধান সমস্যা ইটভাটা। এটির জন্য বিবর্ণ হচ্ছে প্রকৃতি, ইটভাটার মাটির কাটার জন্য নষ্ট হয় বিলের উর্বরা শক্তি। এছাড়া নগরায়নের কবলে পড়ে কমছে আবাদী জমির পরিমাণ। এর বাইরেও গুমাইবিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া বিভিন্ন খালের তলানি ভরাট হয়ে গেল কয়েকবছর থেকে আমন মৌসুমের শুরুতে বন্যার কবলে পড়তে হয়। এবছর গুমাইবিলে বন্যার পানিতে আমন আবাদ ডুবে ছিল বেশ কয়েকদিন। এসব সমস্যা নিরসনের দাবি কৃষক ও সংশ্লিষ্টদের।
গুমাই বিলের চন্দ্রঘোনা এলাকার কৃষক রেজাউল করিম জানান, তিনি এবার ৫ হেক্টর জমিতে আমনের চাষ করেছেন। ধান কাটা শুরু করেছেন। ইতিমধ্যেই দুই হেক্টর জমির ধান কেটে গড়ে প্রায় ৬ টন করে ফলন পেয়েছেন।
হোসনাবাদ অংশের কৃষক আবদুল করিম বলেন, এখন খোলা বাজারে হাইব্রিড জাতের শুকনো ধানের মূল্য কেজি ২৭ টাকা এবং সাদা পাঞ্জাব ৩০ টাকা। এই দাম পেলে কৃষকরা লাভবান হবেন। তবে কোনো সিন্ডিকেট যেন দাম কমিয়ে দিতে না পারে সেজন্য বাজার মনিটরিংয়ের দাবি জানান তিনি।
গুমাই বিলে কর্মরত উপ–সহকারী কৃষি অফিসার উত্তম কুমার বলেন, এবার বিভিন্ন কৃষি মাঠে আগাম জাতের ব্রিধান–৮৭, কাটারি, ব্রিধান–৭৫, ব্রিধান–৯৫সহ বিভিন্ন উন্নত জাতের আবাদ হয়েছে। ১১৫–২০ দিনের মধ্যে এসব ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছেন কৃষকরা। এসব ধান ইতিমধ্যেই কেটে ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। আগামী ৭–১০ দিনের মধ্যে বাকি ধান কাটার উপযুক্ত হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বলেন, গুমাইবিল বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তর বিল এবং রাঙ্গুনিয়ার ঐতিহ্য। এই বিল রক্ষায় স্থানীয়দের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এবার এই বিলে ইতিমধ্যেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। যা কাটা হয়েছে তাতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করি, এবারও ধানের উৎপাদন বরাবরের মতো রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে।