পবিত্র রমজানের বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশে লাখ লাখ টন ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টন পণ্য দেশে পৌঁছে গেছে। পাইপ লাইনেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ পণ্য। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজেও রয়েছে প্রচুর ভোগ্যপণ্য। লাইটারেজ জাহাজগুলোতে খালাসের অপেক্ষায়ও রয়েছে কয়েক লাখ টন পণ্য। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নে পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়লেও দেশে রমজানের প্রয়োজনীয় পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন। রজমানে সরবরাহ চেইন ঠিকঠাক রাখার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আজ চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করেছে।
রমজান দুয়ারে কড়া নাড়লেও প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই বলে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্যের চাহিদা কিছুটা কমে গেছে, তবে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো শংকা নেই। চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে, পবিত্র রমজানকে সামনে রেখে পণ্য আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয় অন্তত তিন মাস আগ থেকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডলার সংকট বা মূল্যবৃদ্ধির কারণে শুরুতে আমদানি প্রক্রিয়া কিছুটা ব্যাহত হলেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নির্দেশনার ফলে আমদানি প্রক্রিয়া পূর্ণ গতিতে সম্পন্ন হয়েছে। ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য লাখ লাখ ডলারের এলসি হয়েছে। এসব পণ্যের একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে দেশে পৌঁছে গেছে। বাকিটাও আসছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টন পণ্য খালাস হয়েছে বলে উল্লেখ করে চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র সাম্প্রতিক তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ১ লাখ ৯৫ হাজার ৮৮১ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। ডাবলি বুট (অ্যাংকর) এসেছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৯১ টন। ছোলা আমদানি হয়েছে ২৪ হাজার ৬৩২ টন। মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৭১ টন। এছাড়া খেজুর আমদানি হয়েছে ২৩ হাজার ১৭০ টন। এছাড়া অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৫৯, পাম অয়েল ৪ লাখ ৮ হাজার ৪৭২ ও অপরিশোধিত চিনি ৪ লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টন আমদানি করা হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পেঁয়াজ আমদানি বেড়েছে ৪১ হাজার ৮৪০ টন। ডাবলি বুটের আমদানি বেড়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭৮১ টন। মসুর ডালের আমদানি বেড়েছে ১৪ হাজার ৩৯১। খেজুর আমদানি বেড়েছে ১৪ হাজার ৮৭৯। অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি বেড়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৮৬৮ টন।
উপরোক্ত আমদানি চিত্রের বিপরীতে দেশীয় প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে। ছোলা এবং মটরসহ দেশে উৎপাদিত ডাল জাতীয় পণ্যের মজুদও ভালো। ছোলার পরিবর্তে ডাবলি বুটের ব্যবহার বেড়েছে। চলতি বছরের রমজানকে সামনে রেখে প্রচুর ডাবলি বুট আমদানি হয়েছে। চিনি আমদানিও স্বাভাবিক। এছাড়া দেশেও চিনি উৎপাদনের ভর মৌসুম চলছে। সরকারি চিনিকলগুলোও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের একাধিক ব্যবসায়ী গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, রমজানে পণ্য সামগ্রী নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। প্রচুর পণ্যের মজুদ রয়েছে। বিক্রিও হচ্ছে। পাইকারি বাজার থেকে ইতোমধ্যে গ্রামেগঞ্জেসহ খুচরা বাজারে পণ্য সামগ্রী যেতে শুরু করেছে। সাপ্লাই চেইনে কোনো সমস্যা নেই। তবে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্য সামগ্রীর দাম কিছুটা বাড়তি বলে উল্লেখ করে ব্যবসায়ীরা বলেন, রমজান আসলে ছোলা, ডাল, পেঁয়াজসহ কিছু পণ্যের চাহিদা বহুলাংশে বেড়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা প্রচুর পণ্য কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে এবার কিছুটা বাড়তি দামে পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে তা সহনীয় বলে তারা উল্লেখ করেন।
চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, রোজার কয়েক মাস আগেই পণ্য আমদানি করেন ব্যবসায়ীরা। তাই আমাদের আমদানি পুরোটাই হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির কারণে এবার চাহিদা সামান্য কম থাকবে বলে উল্লেখ করে আবুল বশর চৌধুরী বলেন, বাজারে পণ্যের কোনো সংকট নেই। দামও কমছে। তিনি বলেন, মটর কেজি প্রতি ৫৫ টাকা থেকে কমে আজ ৪৮. ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ছোলা ১১৮ টাকা থেকে কমে প্রকার এবং মানভেদে ৯০ থেকে ৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মশুরের ডাল প্রতি মণ ৩২৩০ টাকা থেকে কমে ৩১৩০ টাকা, চিনি ৪৩/৪৪শ টাকা থেকে কমে ৪১৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, পণ্যের যোগান এবং সাপ্লাই চেইন সবই ঠিকঠাকভাবে কাজ করায় রমজানের বাজার নিয়ে অস্থিরতা তৈরির কোনো শংকা নেই।
চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ ট্রেড এসোসিয়েশনের সহ–সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম আজাদ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, প্রচুর পণ্য আমদানি হয়েছে। পাইপ লাইনেও প্রচুর মালামাল রয়েছে। তেল ছাড়া বাকি পণ্যের যোগান পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজার পুরোপুরি স্থিতিশীল। রমজানে পেঁয়াজের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে বাজারে। তিনি গতকালের দর উল্লেখ করে বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজ পাইকারি বাজারে ৬৮–৭০, দেশীয় পেঁয়াজ ৩৮–৪০ এবং মেহেরপুরের (দেশীয়, একটু ছোট সাইজ) ২৮–৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া খুবই ভালো মানের আদা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা দরে, রসুন বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি দরে।
রমজানে অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো কারণ নেই বলে মন্তব্য করে তিনি ক্রেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, বাজারে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে একইসাথে পুরো মাসের পণ্য কেনার দরকার নেই। প্রচুর পণ্য আছে। পণ্যের কোনো ঘাটতি রমজানের শেষ দিনেও হবে না। তাই খুচরা বাজারে হুড়োহুড়ি করে কাউকে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগ না দেয়ার জন্যও ব্যবসায়ী নেতা রেজাউল করিম আজাদ আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত ভোগ্য পণ্য লাইটারেজ জাহাজে খালাস করে দেশব্যাপী প্রেরণ করা হয়। লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিডব্লিউটিসিসি’র নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জি এম খান বলেন, প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে। তিনি গত ডিসেম্বর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৮৬৩ টন মটর, ছোলাসহ ডাল জাতীয় পণ্য এবং ৭০ হাজার ৮৯৭ টন চিনি মাদার ভ্যাসেল থেকে খালাস করা হয়েছে বলে জানান। এর বাইরে পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান করছে বলে উল্লেখ করেন।
বাজার পরিস্থিতি নিয়ে প্রশাসন খুবই সজাগ উল্লেখ করে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম দৈনিক আজাদীকে বলেন, রমজানকে সামনে রেখে পণ্য আমদানি স্বাভাবিক গতিতে চলছে। প্রচুর পণ্যের মজুদ রয়েছে দেশে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার কোনো শংকা নেই। তিনি বৃহস্পতিবার (আজ) বিকেল ৪টায় চট্টগ্রামের আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক আহ্বান করার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা সবাই মিলে রমজানে যাতে মানুষের কষ্ট না হয় সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো। আমি ব্যবসায়ীদের কথা শুনবো, তাদের সাথে আলোচনা করবো। আমাদের কথাও তাদের বলবো। ব্যবসায়ীরা যাতে শান্তিতে ব্যবসা করতে পারেন তা আশ্বস্ত করবো। এরপরও যদি কোনো ব্যবসায়ী কোনো ধরনের সিন্ডিকেট করে মানুষকে কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।