আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন বন্দর থেকে খালাসের তোড়জোড়

হাসান আকবর | রবিবার , ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

আমদানি নিষিদ্ধ এবং মিথ্যা ঘোষণার ৫০ কন্টেনারের মতো পুরনো ইঞ্জিন এবং মোটর পার্টস চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের তোড়জোড় চলছে। বেশ কিছুদিন ধরে কন্টেনারগুলো আটকে আছে। সংশ্লিষ্ট একটি গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টির ওপর নজরদারি শুরু করেছে। অপরদিকে পুরনো ইঞ্জিনের ভিতরে স্বর্ণের বার নিয়ে আসার খবরে সতর্ক গোয়েন্দা সংস্থা। অক্সিজেন মোড়ের এক আমদানিকারক ইতোমধ্যে বেশ কিছু স্বর্ণ খালাস করেছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, বিদেশ থেকে পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করা হয় অনেক বছর ধরে। প্রচলিত নিয়মকানুন অনুসরণ করে সাত বছর পর্যন্ত পুরনো ইঞ্জিন আমদানি করার সুযোগ রয়েছে। তবে চেসিসসহ কেবিন, টায়ার, ব্যাটারি আমদানির সুযোগ নেই। এছাড়া চীন ও তাইওয়ানের ইঞ্জিন আমদানি করা যায় না। কিন্তু চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন আমদানিকারক কাগজপত্রে গোঁজামিল দিয়ে কোটি কোটি টাকার আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন ও মোটর পার্টস নিয়ে আসছে। এর মধ্যে চেসিসসহ কেবিন নিয়ে আসার ঘটনা প্রাত্যহিক। পুরো গাড়ি কেটে দুই টুকরা করেও নিয়ে আসা হচ্ছে। চট্টগ্রামের প্রায় প্রত্যেক আমদানিকারকই গোঁজামিল দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ পার্টস নিয়ে আসছে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামের শ’খানেক আমদানিকারক ইঞ্জিন আমদানির সাথে জড়িত হলেও দেড় হাজারের মতো দোকানে এসব ইঞ্জিনের ব্যবসা চলে। দেশে কার, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, জিপসহ বিভিন্ন গাড়ির ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। পুরাতন গাড়ির ইঞ্জিনের মধ্যে চার সিলিন্ডার, ছয় সিলিন্ডার, আট সিলিন্ডার এবং সর্বোচ্চ দশ সিলিন্ডারের ইঞ্জিন আমদানি করা হয়। ইঞ্জিনের শুল্ক আদায় করা হয় সিলিন্ডারের ওপর। ইঞ্জিনের সিলিন্ডার বাড়ার সাথে সাথে শুল্কের পরিমাণও বাড়তে থাকে। প্রচলিত শুল্কনীতি অনুযায়ী বর্তমানে ডিজেল ইঞ্জিনের ক্ষেত্রে চার সিলিন্ডারের একটি পুরনো ইঞ্জিনের দাম ৪০০ ডলার নির্ধারণ করে মোট ট্যাক্স আদায় করা হয় ২৮ হাজার টাকা। ছয় সিলিন্ডারের ক্ষেত্রে দর ৭০৪ ডলার নির্ধারণ করে ট্যাক্স আদায় করা হয় ৩৯ হাজার টাকা। আট সিলিন্ডারের একটি পুরাতন ডিজেল ইঞ্জিনের দর ১৩শ থেকে ১৬শ ডলার নির্ধারণ করে ট্যাক্স আদায় করা হয় ৭৮ হাজার টাকা এবং দশ সিলিন্ডারের একটি ইঞ্জিনের দাম ১৬শ ডলার থেকে ২১শ টাকা নির্ধারণ করে শুল্ক আদায় করা হয় ১ লাখ দশ হাজার টাকা। অপরদিকে পেট্রোল ইঞ্জিন হয় শুধুমাত্র চার সিলিন্ডারের। চার সিলিন্ডারের ৯ম পৃষ্ঠার ১ম কলাম

একটি পেট্রোল ইঞ্জিনের মূল্য ২০০ ডলার নির্ধারণ করে শুল্ক নেওয়া হয় ৯ হাজার ৯০০ টাকা।

আমদানিকারকেরা ডিজেল ইঞ্জিন এবং বেশি সিলিন্ডারের ইঞ্জিন এনে ৪ বা ৬ সিলিন্ডার ঘোষণা দিয়ে খালাস করে নিচ্ছে। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ৮ বা ১০ সিলিন্ডারের একটি ইঞ্জিনকে ৬ সিলিন্ডার ঘোষণা দিয়ে খালাস করলেই ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় গড়ে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আবার ডিজেল ইঞ্জিনকে পেট্রোল ইঞ্জিন ঘোষণা দিলে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয় কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। একেকটি কন্টেনারে ২৮ টন পর্যন্ত ওজনের পণ্য বোঝাই করা হয়। এতে ৪ সিলিন্ডার হলে এক কন্টেনারে কমপক্ষে ৮০টি, ৬ সিলিন্ডার হলে ২৬টি এবং ৮ বা ১০ সিলিন্ডার হলে ১২/১৩টি পুরনো ইঞ্জিন এবং সাথে অন্যান্য পার্টস বোঝাই করা হয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, সংঘবদ্ধ চক্রটি এক কন্টেনার ইঞ্জিন খালাসে লাখ লাখ টাকা ট্যাঙ ফাঁকি দিয়ে থাকে। মিথ্যা ঘোষণা, আমদানি নিষিদ্ধ ইঞ্জিন এবং মোটর পার্টস নিয়ে আসা এবং শুল্ক ফাঁকির ঘটনা পুরনো। চট্টগ্রাম বন্দরে সাম্প্রতিক সময়ে এই ধরনের ইঞ্জিন ও পার্টস বোঝাই ৬০/৭০ কন্টেনার আনা হয়। এর মধ্যে বেশ কিছু কন্টেনার আসে দুবাই থেকে। কন্টেনারগুলোর মধ্যে দশটির মতো ইতোপূর্বে খালাস করা হলেও পঞ্চাশটির মতো কন্টেনার বন্দরের অভ্যন্তরে রয়েছে। সুযোগ করতে না পারায় আমদানি নিষিদ্ধ এবং মিথ্যা ঘোষণার ইঞ্জিন বোঝাই এসব কন্টেনার বন্দরে অঘোষিতভাবে আটকা পড়ে। তবে সম্প্রতি কন্টেনারগুলো খালাস করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাতে কন্টেনারগুলো খালাস করা হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এসব কন্টেনারের মধ্যে দুবাই থেকে আসা কন্টেনারে স্বর্ণের বার থাকার খবর রয়েছে উল্লেখ করে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দুবাই থেকে ইঞ্জিনের চেম্বারে স্বর্ণের বার নিয়ে আসা হয়। অঙিজেন মোড়ের ‘আ’ আদ্যক্ষরের একজন আমদানিকারক ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি চালানে স্বর্ণ নিয়ে আসার সংবাদ রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে। অঙিজেন এলাকার একটি শোরুম এবং তিনটি গুদামের মালিক উক্ত আমদানিকারকের গুদামে বর্তমানে মিথ্যা ঘোষণায় আনা কয়েক কোটি টাকার ইঞ্জিন এবং চেসিসসহ কেবিন (হাফ কাট) রয়েছে। এর মধ্যে চীনা ইঞ্জিনের সংখ্যাও কম নয়। উক্ত আমদানিকারক পুরনো ইঞ্জিনের ব্যবসার আড়ালে মূলত স্বর্ণ চোরাচালান করছেন উল্লেখ করে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মাত্র বছর কয়েকের মধ্যে ওই ব্যক্তি চট্টগ্রাম এবং নিজের জন্মস্থান ফেনীতে কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন।

চট্টগ্রামে আরো কয়েকজন আমদানিকারক পুরনো ইঞ্জিনের ব্যবসার আড়ালে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এর মধ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের অপতৎপরতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে উল্লেখ করে গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেক্টরটিতে কোটি কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকিসহ নানা ধরনের অনিয়ম চলছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা পুরনো ইঞ্জিনের গুদামগুলোতে বড় অভিযান পরিচালনা করা হলে কোটি কোটি টাকার পণ্য জব্দ হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কন্টেনার থাকার কথা উল্লেখ করে কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন না উল্লেখ করে বলেন, কেউ মিথ্যা ঘোষণা বা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য নিয়ে এলে আমরা তা আটক করি। তবে বিভিন্ন সময় নানা পন্থায় কিছু চালান খালাসও হয়ে যায়। গাড়ির ইঞ্জিনের চালান খালাসের সময় সতর্কতা অবলম্বন করব। তবে ইঞ্জিনের ভিতর স্বর্ণ আনার ব্যাপারে কিছু জানেন না উল্লেখ করে তারা বলেন, শত শত পুরনো ইঞ্জিন আমদানি হয়। কোন ইঞ্জিনের চেম্বারের ভিতরে স্বর্ণ লুকানো থাকে তা বের করা কঠিন। বন্দরে প্রতিটি ইঞ্জিন খুলে তল্লাশি চালানোর সুযোগ নেই। তবে কাস্টমস এ ব্যাপারে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকক্সবাজার শহরে বিউটিশিয়ানের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
পরবর্তী নিবন্ধক্ষমতা টেকাতে অনৈতিক কাজ করছে সরকার : ফখরুল