আবৃত্তি চর্চা ইতিহাসের অগ্রণী অংশীদার বোধন

সংস্কৃতি চর্চায় চট্টগ্রাম

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:৩১ পূর্বাহ্ণ

আবৃত্তির শিল্পিত চেতনার আরাধনায় স্থির ও অবিচল থেকে বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রাম- ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি বাঙালি সংস্কৃতির সংগ্রামী কাফেলায় নিজেকে সম্পৃক্ত করে। আবৃত্তি চর্চার কন্টকাকীর্ণ পথে চলার সংকল্পে একত্রিত হতে প্রথম আহ্বান আসে অ্যাডভোকেট সুভাষ চক্রবর্তীর কাছ থেকে। তাঁর সাথে যুক্ত হন অ্যাডভোকেট বিশ্বজিৎ দাশ (ভুলু) এবং অ্যাডভোকেট স্বপন চক্রবর্তী। সংগঠন গড়ার স্বপ্নে সভা ডাকেন এই তিন অ্যাডভোকেট। এই সভায় আরও ছিলেন আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী। একে একে যোগ দেন অ্যাডভোকেট রবিশংকর চক্রবর্তী, প্রশান্ত চক্রবর্তী, রাজীব চক্রবর্তী, দ্বিপান্বিতা চক্রবর্তী, ইন্দিরা চৌধুরী, পারভেজ চৌধুরী, সালমা নিগার ছন্দা, ডা. বাবুল সেন, রোজী মজুমদার, শারমিন রডরিঙ প্রমুখ। প্রশান্ত চক্রবর্তী প্রস্তাবিত বোধন আবৃত্তি পরিষদ নামটি সকলের সমর্থন লাভ করে। সময়ের প্রয়োজনে ক্রমেই বোধনের কার্যক্রম বেড়ে চলে। পর্যায়ক্রমে যুক্ত হন আবৃত্তিশিল্পী রণজিৎ রক্ষিত, নাজমা নিগার, কুমার প্রীতিশ বল, পঞ্চানন চৌধুরী, সুজিত রায়, অ্যাডভোকেট নারায়ণ প্রসাদ বিশ্বাস, ইন্দিরা চৌধুরী, শিল্পী চৌধুরী, সুব্রত চৌধুরী, কামরুল হাসান বাদল, মিলি চৌধুরী, জলি চৌধুরী, অর্পণ ভট্টাচার্য, দেবানন্দ চক্রবর্তী, কমলিকা চক্রবর্তী, জয়শ্রী নন্দী, চন্দ্রিমা লালা, কাকলি সেন, পান্না চক্রবর্তী, মোর্শেদা এলাহী, রবীন্দ্রনাথ চৌধুরী, ফাহমিদা এলাহী পলি, লিপি সেন, শিউলী চৌধুরী, হিন্দোল রায়, প্রীতম মাহমুদ প্রমুখ। ১৯৯৩ এর ৮ অক্টোবর বোধন আবৃত্তি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। আবদুল হালিম দোভাষকে বোধন আবৃত্তি স্কুলের সভাপতি, অঞ্চল চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক এবং পঞ্চানন চৌধুরীকে কোষাধ্যক্ষ করে কার্যকরী পরিষদ গঠন করা হয়। এছাড়াও একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। পাঠক্রম পরিচালনা করার জন্য অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকমণ্ডলী বাছাই করা হয়। অধ্যক্ষ হিসাবে মৃণাল সরকার এবং উপাধ্যক্ষ হিসাবে রণজিৎ রক্ষিতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
‘অজর অমর অক্ষয়’ শিরোনামে বোধন আবৃত্তি পরিষদের প্রথম অনুষ্ঠানটি ১৯৮৭ সালের ৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে বুড্ডিস্ট ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে পরের অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। কবি সাহিত্যিকদের জন্ম-মৃত্যু দিবস এবং বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলো পালনের পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে বোধন প্রতিষ্ঠার প্রথম বছর অতিক্রম করে। ১৯৮৮ সালের শুরুতে স্বৈরাচারের স্টিম রোলার আরও তীব্রতর হয়ে উঠলে বোধন রাজপথে, অলিতে গলিতে নিরন্তর আবৃত্তি চর্চার মাধ্যমে গণ মানুষের আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘির মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভা উপলক্ষে শেখ হাসিনার আগমনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে যে গণহত্যা হয়েছে, তার পরদিন সরকারি কার্ফু উপেক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংক চত্বরে গুটিকয়েক সাংস্কৃতিক কর্মী যে প্রতিবাদী সমাবেশ করে, সেখানে বোধন আবৃত্তি পরিষদের পক্ষে অঞ্চল চৌধুরী ও প্রশান্ত চক্রবর্তী অনুষ্ঠান চলাকালীন পুলিশের লাঠিচার্জ আর নির্যাতনকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি করেন। একইভাবে আবৃত্তির ঝাণ্ডা হাতে ১৯৯০ এর গণতন্ত্র অভিযাত্রায় চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দান, হাটহাজারী, বোয়ালখালী, পটিয়া, আনোয়ারা এবং কক্সবাজারে বোধন আবৃত্তি পরিষদের সাহসী পরিবেশনা ছিল ইতিহাসের অংশ। বোধনের-ছোট বড় মিলিয়ে ১৪০টি প্রযোজনায় সমৃদ্ধ করে তুলেছে এ জনপদের সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসকে। এ সব প্রযোজনা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ১৫০০ বার মঞ্চায়িত হয়েছে।
বোধন আবৃত্তি পরিষদ শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশের আবৃত্তি চর্চা ইতিহাসের অগ্রণী অংশীদার। বিগত ৩৪ বছরে বোধন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবৃত্তি পরিবেশন করেছে কখনও স্থানীয় দলের আমন্ত্রণে, কখনওবা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। ক্রমসংকুচিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির দৃষ্টি সীমানার বাইরে একেবারে গণমানুষের কাছে আবৃত্তিকে নিয়ে যাওয়ায় ছিল বোধনের মূল উদ্দেশ্য।
বোধনের দীর্ঘ পথচলায় বেশ কিছু ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দর্শক নন্দিত অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, নবীন আবৃত্তি শিল্পীদের একক অনুষ্ঠান জাগাও প্রাণের সুপ্ত শক্তি, লেখাপড়া, কবিতায় কথা কই, আবৃত্তি আড্ডা, কবিতার কবি কবিতার ছবি, নিজেরে কর জয়, সকালবেলার পাখি, জাগো সুন্দর, নবীনবরণ, সমাবর্তন, একুশ মানে মাথা নত না করা। বোধন আবৃত্তি পরিষদের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে চট্টগ্রাম বেতারে পৃথকভাবে আবৃত্তির অনুষ্ঠান শুরু হয় ১৯৯৭ সালের আগস্ট মাসে। ম. হামিদ প্রযোজিত বিটিভির উন্মেষ অনুষ্ঠানে ১৯৮৯ সালে বোধন আবৃত্তি পারষদ লোকজ ছড়া পরিবেশন করে। বিটিভিতে এটা ছিল ঢাকার বাইরের কোনো আবৃত্তি সংগঠনের প্রথম অনুষ্ঠান। বোধনের আয়োজনে প্রথম উৎসবটি ছিল ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে; শিশু উৎসব। ২০০২ সালে পনের বছর পূর্তি উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে বোধন আয়োজন করে তিন দিনব্যাপী আবৃত্তি উৎসব। ‘জাগিয়ে দেরে চমক মেরে আছে যারা অর্র্ধচেতন’ শিরোনামে বোধন আয়োজন করে আঠার বছর পূর্তি উৎসব; ২০০৫ সালে। ২০০৯ সালের অক্টোবর; বোধন আবৃত্তি স্কুলের ষোল বছর উপলক্ষে ‘উচ্চারো আজ উচ্চারিত শাণিত উচ্চারণ’ শ্লোগান নিয়ে আয়োজন করা হয় উৎসব। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বোধন ২০১১ সালের জুনে আয়োজন করে দুই দিন ব্যাপী উৎসব। ২০১২ সালটি ছিল বোধনের রজতজয়ন্তীর বছর। বছর জুড়ে ছিল বোধনের বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান। সমাপনী অনুষ্ঠানটি ছিল চারদিন ব্যাপী। বোধন প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের ডিসি হিলে আয়োজন করে বসন্ত উৎসব। সেই উৎসবেরও আজ ১৬টি বছর হতে চলল। পহেলা বৈশাখের উৎসবের মতো বসন্ত উৎসবও হয়েছে চট্টগ্রামের সার্বজনীন উৎসবগুলোর অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আবৃত্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করেছে বোধন। বর্তমানে বোধন আবৃত্তি পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি আবদুল হালিম দোভাষ ও সাধারণ সম্পাদক প্রণব চৌধুরী। বোধন আবৃত্তি পরিষদ আত্মপ্রকাশের প্রথম দশকেই সগর্বে বুক ভরা আকাঙ্খা নিয়ে এ জনপদের প্রতিটি মানুষের কাছে বিনীত উচ্চারণ করতে পেরেছে- ‘জাগাও প্রাণের সুপ্ত শক্তি’। এখন নানা প্রতিবন্ধকতার ভেতরে একাধিক্রমে ৩৫ বছর আবৃত্তি চর্চা করে ঘোষণা দিতে পারে- ‘আমরা আরও সামনে যেতে চাই। আরও সামনে। একেবারে সূর্যোদয়ের দিকে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিষেধাজ্ঞার দিনে মাংস বিক্রি তিন দোকানিকে জরিমানা
পরবর্তী নিবন্ধএগ্রো বিজনেসে চট্টগ্রামের নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ প্রশংসনীয়