আবৃত্তিজন মোসতাক খন্দকার

আবু সাঈদ হান্‌নান | শুক্রবার , ২১ মার্চ, ২০২৫ at ৯:৩৭ পূর্বাহ্ণ

কবিতা নিভৃতির শিল্প। এ শিল্পকে আনন্দবিষাদের গমকে কলকলিয়ে তোলে আবৃত্তি। আবৃত্তি শ্রুতিমুগ্ধ মধুর শিল্প। এই শিল্পকে আত্মীকরণ দুরুহ হলেও মানুষের বোধে কবিতার অনুরণন তোলা কাব্যজনই আস্বাদন করেন কবিতার স্বাদ ও স্বেদ। কবিতা লিখে কবি তার দায় সারেন বটে। কিন্তু কবিতাকে পুনর্নির্মাণ করেন, শ্রোতার কানে, কবিতারপ্রেমির অভিসারে উপভোগ্য করেন আবৃত্তিকাররা। কবিতা মাধাব আর তার মাধবী হলো আবৃত্তি। যার নুপুর নিক্কণ কবিতার অষ্টরসকে প্রস্ফুটিত করে ভোরের সোনালী প্রভায়। কবি ময়ুখ চৌধুরীর কাব্যভাষায় ‘শব্দ আছে, শব্দ থাকবে, শব্দহীন ডিমের মতো’। সত্যিই কবিতার গতরে সুপ্ত ডিমের মতো শব্দকে কণ্ঠের কারুকর্মে কলরোল তোলেন একজন দক্ষ জহুরী আবৃত্তিকার।

বাংলাদেশে আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস সুপ্রাচীন না হলেও একেবারে নবীন নয়। স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এ শিল্প বেশ এগিয়ে যায়। কাজী সব্যসাচী ইসলাম, শিশির কুমার ভাদুড়ী, গোলাম মোস্তফা এঁদেরকে কবিতা চর্চার প্রাণপুরুষ বলে ধরা যায়।

রাজধানী ঢাকার বাইরে সম্ভবত একমাত্র শহর চট্টগ্রামে এ শিল্পকে প্রাতিষ্ঠানীকীকরণ করা হয়। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম হয়ে ওঠে আবৃত্তি চর্চার পাদপীঠ। চট্টগ্রামে এ শিল্পকে যে বা যারা বয়ে নিয়েছেন তাদের অন্যতম সারথী মোসতাক খন্দকার। এ প্রসঙ্গে বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি আল মাহমুদ বলেন– ‘আমি আরো কিছু আবৃত্তিকারের নাম জানি, যারা তাদের কন্ঠমাধুর্যে আমাকে অভিভূত করে রেখেছেন। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের মোসতাক খন্দকার ও ঢাকার প্রজ্ঞা লাবনী। চট্টগ্রামে রাজনীতিনিরপেক্ষ অনেক আবৃত্তিচক্র অনেক দিন ধরে তাদের উচ্চারণবিভূতিকে উচ্চকিত রেখেছে। এর মধ্যে নিঃসন্দেহে আওয়ামী উচ্চারণশিল্পীদের চেয়ে মধুরতর আবৃত্তিকার রয়েছে। একজনের নাম আমি অকপটে বলতে পারি। তার নাম মোসতাক খন্দকার। মোসতাক খন্দকারের আবৃত্তিকলা ও তার দলের স্বরক্ষেপ কৌশল চট্টগ্রামের বিদগ্ধ মানুষের স্মৃতির মণিকোঠায় জমা আছে। (দৈনিক নয়াদিগন্ত, ১১ মে, ২০০৬)

মোসতাক খন্দকার তার আবৃত্তি চর্চা এবং কবিতাপ্রেম দিয়ে কাব্যভুবনে নির্মাণ করেছেন পোক্ত ভিত। শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. আবু সাঈদ শিমুল লিখেন– ‘১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ কেন্টিনে ২৯ জন আবৃত্তি প্রেমীকে নিয়ে মোসতাক খন্দকারের প্রশিক্ষণ কর্মশালাটি আমরা আপাতত প্রথম আবৃত্তি কর্মশালা বলতে পারি। বর্তমানে চট্টগ্রামে বেশ কয়েকজন ভাল আবৃত্তির প্রশিক্ষক আছেন, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, রণজিৎ রক্ষিত, এ কে এম আসাদুজ্জামান, মাহবুব হাসান, সহিদুর রহমান, শান্তনু বিশ্বাস এবং অধুনা মোসতাক খন্দকার। ……… সবচেয়ে সম্ভাবনা নিয়ে আবির্ভূত হন মোসতাক খন্দকার। আবৃত্তি বোধে, ধারণের ক্ষমতায় তিনি এ অঞ্চলের বর্তমান আবৃত্তিকারদের চেয়ে অনেক এগিয়ে।” (‘চট্টগ্রামে আবৃত্তি’ডা. আবু সাঈদ শিমুল, দৈনিক আজাদী, ১০ অক্টোবর, ১৯৯৭)

কবিতার কারুশিল্পী মোসতাক খন্দকার। কবি আসাদ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন– ‘আবৃত্তিকাররা কবিতাকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ক্বণন শীর্ষদের অন্যতম। আর এই কৃতিত্ব ক্বণন’র সভাপতি ও প্রশিক্ষক মোসতাক খন্দকারকে দিতেই হবে।’

আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় বলেন– ‘বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর চট্টলার কতিপয় শিল্পী বাকশিল্পের সৌন্দর্যচর্চচায় দীর্ঘকাল ধরে ব্রতী আছেন। তাদের মধ্যে সার্থক একজনের নাম মোসতাক খন্দকার।’ তিনি কবিতার মতো পেলব সপর্শে নিপুণ কৌশলে তৈরি করেছেন তিন সহস্রাধিক ভাষাকর্মী। যারা বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধিতে নিরলস প্রয়াস চালাচ্ছেন। বাংলা কবিতা আবৃত্তির ইতিহাসে, কবিতার নির্মাণ ইতিহাসে, চট্টগ্রামের আবৃত্তি চর্চার ইতিহাস নির্মাণে মোসতাক এক অত্যুজ্জ্বল নাম। মোসতাক খন্দকারকে এড়িয়ে চট্টগ্রামের কবিতা চর্চার ইতিহাস অসমপূর্ণ। এ বিষয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দৈনিক দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেকের উদ্ধৃতিটি প্রণিধানযোগ্য– ‘আবৃত্তি শিল্প সুন্দর ও শুদ্ধতার চর্চা করতে শেখায়। শুধু আবৃত্তি চর্চার জন্য ৩৬ বছর একটি সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। সবকিছু ঢাকায় হয়, এ কথা সত্য নয়, চট্টগ্রামেও হয়। অন্তত মোসতাক খন্দকার তা প্রমাণ করেছে।’ ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গনের তিন যুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। কবি আল মুজাহিদীর বয়ানে বলতে হয়-‘মোসতাক খন্দকার ক্বণন’র বাতিঘর। তার সহযাত্রীদের অভিযাত্রিকতায় এই ক্বণন একদিন নতুনতর মাত্রা অর্জন করবে।’

মোসতাক খন্দকার আবৃত্তি, আবৃত্তির চর্চা এবং কবিতাকর্মীর মূল্যায়নে উদারহস্ত। পুরস্কৃত করেছেন এপার বাংলা ওপার বাংলার বহু বিদ্বৎজনকে। প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন তরুণ, নবীন কবিতাকর্মী ও সাহিত্যকর্মীদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিডনি ফাউন্ডেশনকে ডায়ালাইসিস মেশিন কেনার অনুদান প্রদান
পরবর্তী নিবন্ধআঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম আনোয়ারা জাকারিয়া এতিমখানার দলিল হস্তান্তর