আবাসিক এলাকার বদলে বিকল্প চিন্তায় সিডিএ

দুই হাজার একর ভূমিতে ১২ হাজার প্লট করার সুযোগ থাকলেও একটিও বরাদ্দ দেয়া যায়নি । নির্ধারিত ‘মৌজা দর’ এবং ‘হুকুম দখলের’ প্রচলিত নিয়মই বড় অন্তরায়

হাসান আকবর | বৃহস্পতিবার , ১ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত ১৬ বছরে কমপক্ষে দুই হাজার একর ভূমিতে পরিকল্পিত আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলার কথা থাকলেও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তা করতে পারেনি। দুই হাজার একর ভূমিতে অন্তত ১২ হাজার প্লট করার সুযোগ থাকলেও সিডিএ একটি প্লটও বরাদ্দ দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় উদ্যোগ নিয়েও পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। সরকার নির্ধারিত ‘মৌজা দর’ এবং ‘হুকুম দখলের’ প্রচলিত নিয়মই চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এতে শুধু আবাসিক এলাকা গড়ে তোলাই বন্ধ হয়ে থাকেনি, সিডিএর আয় রোজগারের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। প্রচলিত নিয়ম এবং ধারণার বাইরে নতুন কিছু করা যায় কিনা তা নিয়ে ইতোমধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আইনে নগরীতে প্রতি বছর ৫০ হেক্টর জায়গা পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার কথা রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আবাসিক বাণিজ্যিক কিংবা শিল্প এলাকা গড়ে তোলার এই বাধ্যবাধকতা চট্টগ্রাম মহানগরীর মাস্টারপ্ল্যানেও রয়েছে। ভূমির অপব্যবহার ঠেকানোর পাশাপাশি রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা, খেলার মাঠউন্মুক্ত স্থান রাখাসহ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতেই পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলার উপরে জোর দেয়া হয়। কোনো শহরে পরিকল্পিত এলাকা গড়ে না উঠলে সেখানে বস্তির সম্প্রসারণ ঘটে, সরু রাস্তায় গাড়ি প্রবেশ করতে পারে না। ফায়ার সার্ভিস এবং অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি সেবাও বিঘ্নিত হয়। মানুষের জীবন, ধনসম্পদ এবং সর্বোপরি নগরজীবন হুমকির মুখে পড়ে। পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা হলে এসব ক্ষেত্রে বেশ ইতিবাচক আবহ তৈরি হয় বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

অপরদিকে আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলার মাধ্যমে সিডিএ শুধু নগরবাসীর আবাসনের ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে না, একই সাথে নিজের আয়রোজগার বৃদ্ধি করে। তহবিল সমৃদ্ধ করে। এসব অর্থ নগরীর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে। নগরীর অনুন্নত এলাকার জমি সস্তায় নিয়ে তা উন্নয়ন করে প্লট হিসেবে বরাদ্দ দেয় সিডিএ। ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গত ৬৩ বছরে নগরীতে ১২টি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেছে। এসব আবাসিক এলাকায় সিডিএ ৬৩৬৪টি প্লট বরাদ্দ দিয়েছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে করা গড়ে তোলা হয় অনন্যা আবাসিক এলাকা। এরপর গত ১৬ বছরে সিডিএ আর কোনো আবাসিক এলাকা গড়ে তুলতে পারেনি। অনন্যা দ্বিতীয় পর্যায়ের একটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেও সফল হয়নি সিডিএ। প্রথমে যেই জায়গা পছন্দ করা হয়েছিল তার মৌজা ভ্যালু চড়া হওয়ায় পিছু হটতে হয় সিডিএকে। পরবর্তীতে হাটহাজারী গিয়ে ভূমি নিয়ে প্রকল্পটি করার চেষ্টা করা হলেও তাও সম্ভব হয়নি। এসব ক্ষেত্রে ভূমির মৌজা ভ্যালু এবং হুকুম দখল করতে হলে তিনগুণ দাম দেয়ার নিয়মই সিডিএকে পিছু হটাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

তারা বলেন, হাটহাজারীর একেবারে অনুন্নত এলাকায় যেখানে রাস্তাঘাটও নেই, চলাচলের কোনো পথ নেই এমন একটি জায়গায় প্রতি কাঠা ভূমি যদি ২০ লাখ টাকার বেশি দামে হুকুম দখল করতে হয় তাহলে প্লট করে বিক্রি করা অসম্ভব। তিনি বলেন, কাঠা প্রতি ২০ লাখ টাকায় হুকুম দখল করার পর ভূমি উন্নয়ন রাস্তাঘাট নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করে প্লট তৈরি করার ক্ষেত্রে কাঠা প্রতি আরো ৮১০ লাখ টাকা খরচ যুুক্ত হয়। রাস্তাঘাট, খেলার মাঠসহ আবাসিক এলাকার নাগরিক সুবিধাগুলো তৈরি করতে প্রচুর খরচ। এক্ষেত্রে কাঠা প্রতি ৩০৩৫ লাখ টাকা খরচ করে প্রতি কাঠা ৪০ লাখ টাকা দামে ওই প্লট সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করা কঠিন। এতো চড়া দামে শহর থেকে এত দূরে গিয়ে মানুষ কেন প্লট কিনবে সেই শংকায় ২০১৬ সালে ‘অনন্যা আবাসিক (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রকল্প’ হিমাগারে চলে গেছে। একনেকে পাশ হওয়া ২ হাজার ৮৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকার প্রকল্পটি পাঁচলাইশ, কুয়াইশ ও বাথুয়া মৌজার ৪১৮ দশমিক ৭৩ একর জমির ওপর করার কথা ছিল। পরবর্তীতে মৌজা রেটের কারণে পাঁচলাইশ এবং কুয়াইশ মৌজার ভূমি বাদ দিয়ে হাটহাজারীর বাথুয়া ও শিকারপুর মৌজার ২৭৬ একর জায়গায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু হাটহাজারীর বাথুয়া এবং শিকারপুরেও ৩৫৪০ লাখ টাকার কমে প্লট বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে না বিধায় কাটছাঁড় করা প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভূমির মৌজা রেট প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি প্রায় তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে। আবার হুকুম দখল করতে ওই মৌজা রেটের তিনগুণ টাকা প্রদানের নিয়ম থাকায় সিডিএ আবাসিক এলাকা করতে পারছে না।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রচলিত নিয়মে চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা করার মতো পরিস্থিতি নেই বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ এবং ভূমি উন্নয়ন করে আবাসিক এলাকা করার মতো অবস্থা নেই। প্রচুর অর্থ খরচ করতে হবে। মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মাঝে প্লট দেয়া সম্ভব হবে না। একটি তিন কাঠার প্লটের দামই কোটি টাকা পড়ে যাবে। আমরা ক্রেতা পাবো না। তাই বিকল্প ভাবতে হবে। বিষয়টি নিয়ে বিকল্প নানা প্রস্তাবও আসছে বলে উল্লেখ করে অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পরামর্শ এসেছে। এগুলো নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে সিডিএর আয় রোজগার বাড়ানো জরুরি বলেও বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।

বিষয়টি নিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউনুছের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে কোনো পরিকল্পিত এলাকা গড়ে তোলা যায়নি এটা ঠিক। তবে আমিও নতুন। মাত্র তিনমাস আগে বসেছি। এখন আমি সবুজে ছেয়ে থাকা নগরী গড়ার উদ্যোগ নিয়েছি। পরিকল্পিতভাবে সবুজায়ন করার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর্ণফুলীর পাড়ের লিংক রোডে আগামী শনিবার বৃক্ষরোপণ শুরু হবে। এরপর সলিমপুর আবাসিক এলাকায়ও বেশ কিছু কাজ করবো। কর্ণফুলীর পাড়েও মানুষের অবসর কাটানো এবং হাঁটার জন্য ওয়াকওয়েসহ সবুজ, হলুদ এবং বেগুণি ফুল হয় এমন সব গাছ লাগাবো।

ফতেয়াবাদ এবং জঙ্গল সলিমপুরে দুইটি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার উদ্যোগের কথা জানিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, সবাইকে সাথে নিয়ে, সবার পরামর্শ নিয়ে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজামায়াত নিষিদ্ধ হবে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি