বিশ্বের নানাদেশ থেকে সমুদ্রপথে দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহন নিয়ে দেশি–বিদেশি জাহাজের বিরোধ বাড়ছে। দেশিয় জাহাজের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রণীত আইনের কড়াকড়িতে এই বিরোধ তুঙ্গে উঠছে। আইন লঙ্ঘনের দায়ে দুইটি বিদেশি কন্টেনার জাহাজকে একইদিনে দশ লাখ জরিমানার একদিনের মাথায় নতুন করে একটি জাহাজকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেয়ায় বিদেশি জাহাজ মালিকদের স্থানীয় এজেন্টদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল ঢাকায় বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বৈঠক করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ পরিচালনা অব্যাহত রাখার স্বার্থে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। ইতোপূর্বে চট্টগ্রাম থেকে জাহাজ প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছিল। এবারও নতুন করে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত আসছে কিনা তা নিয়ে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মাঝে শংকা বিরাজ করছে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের পক্ষ থেকে বিদেশি জাহাজ মালিকদের যে কোনো সিদ্ধান্ত মোকাবেলা করার মতো সক্ষমতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে আগামী ২০ নভেম্বর বেলা ১১টায় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হবে। অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের আমদানি রপ্তানি পণ্যের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ যাতে দেশিয় পতাকাবাহী জাহাজ পরিবহন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ ফ্ল্যাগ ভ্যাসেল প্রোটেকশন এ্যাক্ট’২০১৯ প্রণয়ন করা হয়। দেশের সরকারি এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজগুলোকে সুরক্ষা দিতেই আইনটি করা হয়। বিদ্যমান এই আইনে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলোতে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজগুলোকে একটি এনওসি বা অনাপত্তিপত্র নেয়ার বাধ্যবাধকতায় আনা হয়েছে। চট্টগ্রাম এবং মোংলাসহ দেশের বন্দরের পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশের বন্দরে বাংলাদেশি আমদানি কিংবা রপ্তানি পণ্য পরিবহন করতে আগেভাগে মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের প্রিন্সিপ্যাল অফিসার (পিও–এমএমডি) থেকে এনওসি বা ছাড়পত্র নিতে হয়। মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) প্রিন্সিপ্যাল অফিসার বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি) এবং বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ওশনগোয়িং শিপ ওনার্স এসোসিয়েশনের (বগসোয়া) কাছ থেকে অনাপত্তি নিয়ে এই ওয়েভার সনদ ইস্যু করে। সংশ্লিষ্ট বন্দরে দেশিয় পতাকাবাহী কোনো জাহাজ নেই বা পরবর্তী ১৫দিনের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সিডিউল নেই মর্মে নিশ্চিত হওয়ার পরই বিদেশি জাহাজকে পণ্য বোঝাইয়ের ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। এই ওয়েভার সনদ পাওয়ার পরই কেবল ওই বিদেশি জাহাজ পণ্য বোঝাই করতে পারে। কোনো বন্দরে বাংলাদেশি জাহাজ নোঙর করা থাকলে বা পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পৌঁছার সিডিউল থাকলে ওই বন্দরে বাংলাদেশমুখী কোনো পণ্য বিদেশি জাহাজ লোড করতে পারে না। একইভাবে চট্টগ্রাম বা মোংলা থেকেও বিদেশের কোনো বন্দরগামী জাহাজ যদি থাকে তাহলে ওই বন্দরমুখী রপ্তানি পণ্যও জাহাজগুলো বোঝাই করতে পারে না।
এই আইনটি বেশ কয়েকবছর আগের। একসময় অর্ডিনেন্স থাকলেও ২০১৯ সালে সেটি আইনে পরিণত হয়। তবে এই আইনটি বাস্তবায়নে অতীতে বাংলাদেশ কখনো কড়াকড়ি করেনি। দেশিয় জাহাজের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় এই আইন নিয়ে কড়াকড়ির সুযোগও ছিল না। এখনো দেশিয় মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা প্রত্যাশিত পর্যায়ে উন্নীত হয়নি, তবে গত বেশ কয়েকমাস ধরে আইনটি বাস্তবায়নে কড়াকড়ি করা হচ্ছে। ছাড়পত্র নেয়ার ব্যাপারটি বাস্তবায়নে কড়াকড়ি আরোপ করায় বিদেশি জাহাজগুলো সংকটে পড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েভার সনদ বা পণ্য বোঝাইয়ের অনুমোদন নেয়ার বিষয়টি বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজগুলোর জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে উঠে। নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েভার সনদ না পাওয়ায় বহু জাহাজই পণ্য বোঝাই করতে পারে না। আবার পণ্য না নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষুদ্ধ হয়ে চট্টগ্রাম এবং মোংলা রুট থেকে জাহাজও প্রত্যাহার করা হয়েছে। মাঝে কিছুদিন কিছুটা নমনীয় থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইস্যুটি আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। এতে করে বিদেশি জাহাজগুলো বেকায়দায় পড়েছে। ওয়েভার সনদ না পেয়ে অনেকেই পণ্য বোঝাই করতে পারছে না। আবার কোনো কোনো বিদেশি জাহাজ সনদ না নিয়েই পণ্য পরিবহন করার চেষ্টা করছে। গত ১৩ নভেম্বর এই ধরণের দুইটি জাহাজকে ৫ লাখ টাকা করে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এমভি এঙপ্রেস লহটসে এবং এমভি সোল প্রমিজ নামের জাহাজ দুইটিকে দশ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর একদিনের মাথায় এমভি এঙপ্রেস নীলওয়ালা জাহাজকে ওয়েভার সনদ ছাড়া পণ্য পরিবহন করায় কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তার কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে বিদেশি জাহাজ মালিকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, এভাবে তো আসলে হয় না। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা বিষয়টি বুঝিয়ে নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবরে চিঠি দিয়েছি। কথা বলেছি। কিন্তু সংকটের সুরাহা হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আবারো কথা বলবেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, যা শুরু হয়েছে তাতে চট্টগ্রাম এবং মোংলার সাথে কলম্বো বন্দরের জাহাজ পরিচালনা সম্ভব হবে না। দেশের সমুদ্র বাণিজ্যের ব্যবসা একচেটিয়া হয়ে গেলে দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
একাধিক শিপিং ব্যবসায়ী বলেছেন, বাংলাদেশ প্রচুর পণ্য আমদানি করে। রপ্তানিও করে। এই ভলিউম বেশ বড়। তবে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা মাত্র ৯০টি। এরমধ্যে মাত্র ৮টি কন্টেনার জাহাজ। এত স্বল্প সংখ্যক জাহাজ দিয়ে দেশের বিপুল পরিমাণ পণ্য হ্যান্ডলিং করা সম্ভব নয়। আবার ওয়েভার ইস্যু নিয়ে বিদেশি জাহাজগুলোও পণ্য বোঝাই করতে পারছে না। ফলে পণ্য পরিবহন নিয়েও সংকট তৈরি হচ্ছে।
দেশি–বিদেশি জাহাজের বিরোধের মাঝে দেশের পণ্য পরিবহন যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সজাগ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে।
মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্টের (এমএমডি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইন। এই আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার সুযোগ কারো নেই। মার্কেন্টাইল মেরিন ডিপার্টমেন্ট শুধু আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ব্যাপার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ওয়ার্ল্ড শিপিং কাউন্সিল অনেক বড় একটি সংগঠন। অলাভজনক এই সংগঠন জাহাজ মালিকদের স্বার্থ দেখে। বিষয়টি নিয়ে ইতোপূর্বে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে পত্র দিয়েছে। তারা বলেন, দেশিয় জাহাজ শিল্পের স্বার্থে প্রণীত বিদ্যমান আইনের কড়াকড়ি আমাদের সার্বিক সমুদ্র বাণিজ্যকে ব্যাহত করবে। কারণ বিদেশি জাহাজগুলোকে বাদ দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করার মতো সক্ষমতা আমাদের নেই। খোলা পণ্যের কথা বাদ দিলেও শুধু আমাদের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে ৯০ টি ফিডার ভ্যাসেল লাগে। সেখানে দেশিয় মাত্র ৮টি জাহাজ দিয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে না। নিজেদের সক্ষমতা অর্জনের আগে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে বলেও তারা মন্তব্য করেছেন।