দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়ন ফরম কেনাও শুরু হয়েছে। এদিকে আবার হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচিও চলছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাখাত। সপ্তাহের পাঁচ দিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাস–পরীক্ষা চললেও কিছুদিন ধরে হরতাল–অবরোধের কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। স্কুল–কলেজ খোলা থাকলেও ছাত্র–ছাত্রীদের উপস্থিতির হার ছিল খুবই কম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবার ফিরে যাচ্ছে অনলাইন পাঠদানে।
আমরা জানি, ‘কোভিড প্রাদুর্ভাবের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাসের বিস্তার ঘটে অতিদ্রুত। প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা–সব পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমকে স্বাভাবিক রাখতে অনলাইনে ক্লাস চালু করে প্রায় সব কটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সচেতনতা বৃদ্ধি, টিকাদান কর্মসূচিসহ নানা পদক্ষেপে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আসায় পাঠদানের ক্ষেত্রে অনলাইন পদ্ধতির ব্যবহার অনেকটাই কমে এসেছিল। হরতাল–অবরোধকে ঘিরে বর্তমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আবারো বাধ্য হচ্ছে অনলাইন পাঠদানে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। পরীক্ষা গ্রহণ ও মূল্যায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। হরতাল–অবরোধে বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। এখন পর্যন্ত বড় ধরনের সমস্যা না হলেও পরবর্তী কর্মসূচিগুলো সহিংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সে কারণে বার্ষিক পরীক্ষা বা মূল্যায়ন ‘অসম্পূর্ণ’ রেখেই শিক্ষাবর্ষের ইতি টানতে হতে পারে বলে আশঙ্কা শিক্ষা–সংশ্লিষ্টদের।
হরতাল–অবরোধ চলাকালীন বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। ফলে সড়কে ব্যক্তিগত যানবাহনসহ গণপরিবহণের সংখ্যা থাকে অনেক কম। এমন বাস্তবতায় স্কুল–কলেজের পরীক্ষা ও ক্লাস থাকায় ঝুঁকি নিয়ে তাদের ঘর থেকে বের হতে হয়। অনেক অভিভাবক ঝুঁকি নিয়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চান না।
তাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জানানো হয়েছে, যেসব শিক্ষার্থী হরতাল কিংবা অবরোধে স্কুলে আসতে পারছে না, তাদের স্কুলে অনুপস্থিত দেখানো যাবে না। বরং ক্লাসে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস করাতে নির্দেশনা দিয়েছে মাউশি। হরতালে স্কুল–কলেজে শিক্ষক–শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি নিয়ে উপস্থিত হতে হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না থাকলেও রুটিনমাফিক স্কুল–কলেজে আসা–যাওয়ায় নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এদিকে, হরতাল–অবরোধের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন রাজধানীর ১৫টি স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে কর্মসূচিতে অংশ নেন শিক্ষকরাও। গত ২১ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নিজ নিজ স্কুলের সামনে এবং আশপাশের সড়কে এ কর্মসূচি করেন তারা। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীদের হাতে ‘সময়মতো পরীক্ষা দিতে চাই’, ‘নিরাপদ শিক্ষাজীবন চাই’, ‘শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। শিক্ষার্থীরা জানায়, নভেম্বর–ডিসেম্বর মাসে তাদের বার্ষিক পরীক্ষা থাকে। এই সময়টাতে তারা হরতাল–অবরোধের মতো কর্মসূচি চায় না। এজন্য তারা মানবনন্ধনে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকরা বলেন, আমরা শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ চাই। নির্ভয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে চায়, নিরাপদে পরীক্ষা দিতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমাদেরও একই আহ্বান থাকবে। তাঁরা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের শিক্ষার্থীরা বেশ পিছিয়ে পড়েছে। তাদের শিক্ষাজীবনে যে গ্যাপ, তা এখন পূরণে আমরা তৎপর। এরমধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে বারবার পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষার্থীরা অনেক পিছিয়ে যাবে।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে না। তাদের কর্মসূচির কারণে শিক্ষার্থী–অভিভাবকরা আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। সে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর আরও সহনশীল হওয়া প্রয়োজন। কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরীর বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। তিনি বলেন, কিন্ডারগার্টেনে এখনো পরীক্ষা শুরু হয়নি। ক্লাস চললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। আজ–কালের মধ্যে পরীক্ষা শুরু হতে পারে। হরতাল–অবরোধের কারণে অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় শুক্র ও শনিবারও পরীক্ষা হতে পারে।
সামপ্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরুর পর পরই অনলাইনে পাঠদান শুরু হয়েছে দেশের অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম, কিন্ডারগার্টেন ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দু–একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় সব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই বর্তমানে অনলাইন–অফলাইন সমন্বয়ে পাঠদান শুরু করেছে। এক্ষেত্রে শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার সশরীরে ক্লাস–পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে এবং বাকি দুদিন অনলাইনে ক্লাস নেয়া হচ্ছে।
অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি থেকে যাবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরাও। তাঁরা বলেন, পরিপূর্ণ শিক্ষা সেটাই যেখানে শিক্ষক একটা বিষয় বলবেন, বোঝাবেন এবং শিক্ষার্থী সরাসরি সে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবেন। এখানে আই কনট্যাক্ট, মুখভঙ্গিসহ সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনলাইন শিক্ষায় এ বিষয়ে ঘাটতি থাকে। তাই অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে শিখন ঘাটতি পূরণ সম্ভব নয়। এমনকি অনলাইন শিক্ষা সশরীরে শিক্ষার বিকল্পও হতে পারে না।